Thursday, 21 March 2019

ভাড়াটে চাই

চন্দ্রনাথ চন্দ্র বাবু বললেন ওনার বাড়ির একটা ছবি তুলে দিতে। ভাড়াটে চাই। ওদিকে দালালের উৎপাত খুব। মোটা কমিশন চায়। তাই অনলাইন এ এড দেবেন। নেইল আর্মস্ট্রং এর পরিবার এরও কেউ ওনার জমির ভাগ দাবী টাবী করবে বলে মনে হচ্ছে না।
ওখানের লোকজন যে ভাড়া চাইছে না তা নয়, তবে সব নেহাতই নাকউঁচু। ওনার ওখানে কারোরই মাটিতে পা পড়ে না। পৃথিবীর লোকেদের নাকি শুনেছেন মাটিতেই পা। সর্বদা। ভারী অবাক কান্ড! সবাই একেবারে মা-মাটি-ইয়ে! সব থেকে মজার ব্যাপার হলো, চন্দ্রনাথ চন্দ্র বাবু শুনেছেন ওনাকে নিয়ে নাকি একমিনিটে একলিটার কবিতা নামিয়ে ফ্যালে পৃথিবীর মানুষেরা। নিন্দুকেরা অবশ্য বলে, কবিতা ওনাকে নিয়ে নয়, ওনার বৌকে নিয়ে। তা সে যাই হোক, বৌকে নিয়ে কেউ কবিতা লিখলে ওনার রাগ হবে এমন মর্কট উনি নন। বরং গর্বে ওনার বুক একেবারে গুলুগুলু করে ওঠে। বৌ যে ওনার কাব্য-ফ্রেন্ডলি, তা উনি শুভ-দৃষ্টির সময়ই বুঝে গিয়েছিলেন। চন্দ্রাহত হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। স্বয়ং সূর্য-এর সাথে যার কোলাবোরেশন, বাওয়া। প্রভাবশালী বললেও বড়ো কম বলা হয়। তাই পৃথিবীর লোকজন ভাড়াটে হিসেবে পেলে উনি বেজায় খুশি হন।
============


P.S.আজকের চাঁদ, ক্লিকড ফ্রম ছাদ।

Wednesday, 13 March 2019

নিউট্রোপিয়া


সে এক ভারী মজার দেশ। সে দেশে কেউ কাঁদে না। কেউ উচ্চস্বরে গালাগাল দেয় না। এমনকি কেউ জোরে জোরে হাসেও,  না কারণ তাতে আশেপাশের লোকজন চমকে যেতে পারে, বাচ্চা ভয় পেতে পারে, কাঁদতে পারে। এ দেশের রাস্তায়, লিফ্টে, ঘরে এমনকি বাথরুমেও ক্যামেরা। হ্যাঁ। নিরাপত্তার প্রয়োজনে। সবাই কি করছে, কি ভাবছে, কি বুঝছে, কি বুঝতে চাইছে সবটাই ওই দেশের রাজার দখলে। দেশের মানুষেরা তাই সবাই বেশ সংযত এবং নিয়ন্ত্রিত। ধর্ষণ তো দূরের কথা এখানে কারোর গায়ে টোকা মারলেই ওই এলাকা বরাবর একটা লাল আলো জ্বলে ওঠে আর সাথে সাথে ক্ষণক্ষণে একটা সাইরেন। টোকা মারা লোকটার ওপর স্পটলাইট পরে। তারপর পুলিশ এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তার বিচার হয়। কাউকে ছোঁয়া এখানে সমস্যাজনক বলে এবং সর্বত্র ক্যামেরা আছে বলে বিশেষ নিয়ম যৌনতার ক্ষেত্রে। যৌনতার জন্য রেজিস্ট্রেশন করাতে হয় সরকারের কাছে এই যেমন বিয়ের জন্য করে থাকি আমরা। সেই রেজিস্ট্রেশনের সময় একটি দিন ধার্য্য হয় যেদিন তার বাড়ির ক্যামেরা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ  থাকে। বিয়ে এখানে নিষিদ্ধ। সিগারেট-মদ-গাঁজা এসব যে যেখানে যখন ইচ্ছে খেতে পারে। টিভি সিরিয়াল আর নীল ছবির প্রচুর যোগান। কারোর যদি একটু কষ্ট-কষ্ট পায় কখনো বা কি যেন নেই কি যেন নেই ভাব আসে তার জন্য আছে একটা ছোট্ট ট্যাবলেট, যা সবসময় পকেটে রাখাই নিয়ম। সেটা খেয়ে নিলেই ব্যাস, ঘুম এসে যাবে কিছুক্ষনের জন্য। আর ঘুমলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রত্যেকেই এখানে সবসময় কিছু না কিছু করছেন আর নাহলে ঘুমোচ্ছেন। এখানে সবাই সচেতন এক একটি মেশিন। সবাই পরাধীন আর তাই সবাই সুখী। কারণ কেউ এখানে আলাদা করে ভাবে না, ভাবতে পারে না। কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না, কারণ তার যা চাই অর্থাৎ খাবার, যৌনতা, পোশাক, বাসস্থান সবই আছে বা চাইলে পাওয়া যায়। যেহেতু সবটাই নিয়মমাফিক তাই রাজা ছাড়া কেউ বেশি পেলো বা কম সেই রকম কোনো গরমিল নেই। তাই ঈর্ষাও নেই। বিয়ে নেই যে ওর বৌ বা বর বেশি সুন্দর তাই নিয়ে আক্ষেপ। তাই এই দেশকে চাইলে Sir Thomas More এর ইউটোপিয়া বলা যেতে পারে। সেই রূপকথার দেশের মতো যেখানে সবাই খুশি। বা রবি ঠাকুরের তাসের দেশ বলা যাতে পারে।
সংস্কৃতি এখানে কেউ বোঝে না কারণ তাতে ভাবনার প্রয়োজন।
কিন্তু হঠাৎ একটা পূর্ণিমা চাঁদ উঠলে কারোর মনে ভাবাবেগ এলে, কারোর যদি এই নিয়মের বাইরে যেতে ইচ্ছে করে, কারোর যদি কোনোরকম রেজিস্ট্রেশন ছাড়া এখন এই মুহূর্তে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, কারোর যদি মায়ের কোলে শুয়ে একটু ভানুর কমেডি শুনে চিৎকার করে হা হা করে হাসতে ইচ্ছে করে তাহলে? তাহলে সেটা বিদ্রোহ। তাহলে হয় তার শাস্তি হবে বা যদি বিদ্রোহ ব্যাপক মাত্রাতে হয় যখন হীরক রাজা নিজেই এসে নিজের মূর্তি ভাঙে, তখন ইউটোপিয়া ভেঙে সব আজকের মতো হয়ে যাবে।
আমরা তো সবাই ইউটোপিয়া চাই যেখানে সবাই খুশি কিন্তু তা ঠিক এইরকম আশা করিনা। সবকিছু একদম সঠিক, নিয়মমাফিক তাতে দমবন্ধ হয়ে আসে। স্বাধীনতা, এলোমেলো, ইচ্ছেমতো এসব জিনিস বড় সুস্বাদু, একবার পেলে ঠেকিয়ে রাখা মুশকিল। ওই দেশে তাই আমার আর যাওয়া হলো না। এই আমার নিউট্রোপিয়া তেই দিব্ব্যি আছি। একটা আলোর দিকে এগিয়ে চলার প্রত্যাশা নিয়েই এগিয়ে চলেছি। এই বেশ।

Thursday, 7 March 2019

তরু দত্ত

শাড়ি, পেটিকোট, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, সিগারেট, বিয়ারের অলস বোতল এসব অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের মাঝে, ক্রিকেট খেলা, গাঁজা টানা যতটা মানানসই আর টানটান, মাঝে ওওওই সমাধিগুলো ততটাই বেমানান, অসঙ্গত। কেন যে আছে, কে জানে! নেহাত তাঁরা আগে থেকেই আছে, না হলে কোনোমতেই  ......
==========
২১ বছর বয়স মানে তো এই কচিটি। এই তো সবে কলেজ। এখন তো একটু খেলাধুলো করার সময়। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা টাবনা ওসবে এখন ঢের সময় বাকি।
তবে যদি কারোর জীবৎকাল হয় ২১ বছর, তাহলে?
তরুলতা দত্ত। কলকাতায় জন্ম, মৃত্যুও। মাঝে ৩ বছর ইংল্যান্ড। জীবৎকাল ২১ বছর। এরমধ্যেই ৪টি ভাষাতে ( বাংলা,ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, সংস্কৃত) পারদর্শী, লিখে ফেলেছেন দুটি নভেল। তার মধ্যে একটি Bianca or The Young Spanish Maiden ইংরিজিতে। অন্যটি Le Journal de Mademoiselle d’Arvers ফরাসিতে। বই অনুবাদ করেছেন দুটি, একটি ফরাসি থেকে ইংরিজিতে (প্রায় ৬৫ বিভিন্ন কবির কবিতা সংকলন), অন্যটি সংস্কৃত (পুরাণকাহিনী) থেকে ইংরিজিতে। জীবনের শেষ ৩ বছর নিয়মিত লিখেছেন The Bengal এবং The Calcutta Review ম্যাগাজিনে। মাইকেল মধুসুদন দত্ত এবং তরু দত্ত। পদবি ছাড়া আর একটি মিল তাঁদের। দুজনেই প্রথম ভারতীয় যাঁরা ইংরিজিতে কাব্যচর্চা করেছেন। মহিলা হিসেবে বলাই বাহুল্য ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে তরু দত্তই প্রথম, ইংল্যান্ডে যাঁর লেখার উচ্ছসিত প্রশংসা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পরেও বহুদিন। বাঙালি এই মেয়েটিকে বাংলার কিট্স্ বলা হয়।

এখন তিনি মানিকতলা ক্রিস্টান সমাধিতে। হয়তো নিশ্চিন্তেই শুয়ে আছেন, মাটির ওপরের জগৎ নিয়ে আদৌ কোনো মাথাব্যথা নেই। এদিকে মাটির ওপরের মানুষদেরও মাথাব্যথা নেই। ২১ পেরিয়ে ৪১ হয়ে গিয়েও রসগোল্লা আর পাশবালিশেই তাদের লব্ধি এবং সিদ্ধি। মাঝে মাঝে মনে হয়, তরু দত্ত একদিন সমাধি থেকে বেরিয়ে যদি নিজের কর্মকাহিনীর একটি অনুগল্প একটু শুনিয়ে যেতেন, তাঁর সমাধির ওপর ঠেক বসাতে একটু বুক তো কাঁপতো গাঁজাখোরদের। রবি ঠাকুরের বাড়িতে ছেলে মেয়েরা হাতে হাত ধরে ঘুরলে যারা "কি শিক্ষা, শেষ অবধি এখানেও  ..... " বলে মুখ ব্যাকান, রাস্তায় চুমু তো দূরের কথা একটু কাছাকাছি বসলে যাদের হার্টএট্যাক হয়, তাঁরা নিজের বাড়ির ছেলেমেয়েদের, পরিচিতদের, এমনকি নিজেকেও একটু তরু দত্তের গল্প বলুন না কেন! গর্ব করা যাক বাঙালি হিসেবে, নারী হিসেবে আর মনুষ্যজন্মলাভের স্বার্থকতার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে।
প্রণাম এই আগুনকে। ১৮৫৬এর তরু দত্তকে।