Saturday, 25 January 2020

পার্কসার্কাসের সার্কাস

হুন্ডাই থেকে হন্ডা মেয়ে টানে বেশি। অভীক এর প্রতিটি উইকেন্ড হন্ডা কেনার পর থেকে জব্বর কাটছে। কলেজের সিনিয়র - জুনিয়র এরা তো ছিলই। এখন সানন্দার কভার মডেলরাও ইসি। আর তাছাড়া আজকাল সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আনসোশাল হওয়াটা অনেক বেশ সহজ। তার ওপর বিংশ শতাব্দীর সুবিধা হলো, ইনিয়ে বিনিয়ে প্রেমের কথা বলে গাড়িতে ডাকতে হয় না। হন্ডা, আর সাথে সমপ্লেসএলসের অফার পেলেই ব্যাপারটা স্মুথ। গাড়ির কাঁচে ব্ল্যাক ফিল্ম লাগানোটা বেআইনি। অভীক এর তাতেই ডেয়ারিং হওয়ার এডভেঞ্চার। ফিল্ম লাগানো কাঁচের গাড়ি থাকলে, বাইরের লোকজন ভিতরের কিছু দেখতে পায় না। তাতে বান্ধবীকে বাড়িতে ডেকে এনে ঝামেলা বাড়ানোর চাপ নেই। জীবনে ফ্লেক্সিবিলিটি খুব দরকার। এই যুগের ছেলেমেয়েরা সবাই খুব ফ্লেক্সিবল। সরস্বতী পুজোর পর কুল খাওয়া দিন গন। এখন সবাই "কুল"। তাতে মাঝে মাঝে এক দুটো ভুল হয় বটে। কিন্তু সেসব ভেবে উইকেন্ড খারাপ করা যায় না। এরকম বেশ কয়েকটা উইকেন্ড কুল অভীক, কুল মোনালিসার সাথে কোলাকুলি কাটিয়ে নেওয়ার পর, যখন পাশ কাটিয়ে সোনা আর লিসাদের দিকে ঝুঁকছে, মোনালিসা এ জিনিস মেনে নিতে পারছে না। কুল হতে গিয়ে ইমোশনাল ভুল হয়ে গেছে। এইখানে হয়ে যায় সমস্যা। ফ্লেক্সিবিলিটির মজা নিতে নিতে আজকের সোনা-মনারা ভুলে যায় যে বেশি টানাটানি করলে ফ্লেক্সিবিলিটি টুং করে ছিঁড়ে যেতে পারে, অন্তত সম্ভাবনা থেকেই যায়। অনুনয়, বিনয়, আবেগ, ভালোবাসা, মোহ আর নানা রকম হাতিয়ারেও কাজ না হতে মোনালিসা প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকে। তাতে অভীকের কিছু যায় আসে নি।
মোনালিসার ভাই কয়েকটা উইকেন্ড অভীককে ফলো করে দেখে নিয়েছে উইকেন্ডে হন্ডা কোথায় কোথায় যায়। গাড়ি চাঁদনীচক থেকে পার্কস্ট্রিট আসে। সেখান থেকে "জলযোগ" হয় তারপর পার্কসার্কাসে গাড়ি বেশ কিছুক্ষন দাঁড়ায়।
থার্টি ফার্স্ট। গাড়ি আজ অনেক বেশি চনমনে। হন্ডা গ্যারাজ থেকে এসেছে আজই আরও ধোপদুরস্ত হয়ে নতুন চকচকে রঙে। বান্ধবীর সাথে অভীকের এক্সসাইটমেন্টের লেভেলটাই আজ মধ্যগগনে। গাড়ি চাঁদনীচক, পার্কস্ট্রিট হয়ে এখন পার্কসার্কাসে দাঁড়িয়েছে দশমিনিট। আশেপাশের লোকজন একটু বেশিই দেখছে আজ গাড়িটাকে।
ঠোঁটে চুমু, বিয়ারে চুমু, নেশা তখন টানটান। গাড়িতে নক, হালকা তারপর জোড়ে, ভীষণ জোড়ে, ভীষণ রকম জোড়ে। পুলিশ।
========
অভীক এখন পুলিশের কাস্টডিতে। নাঃ গাড়ির কাঁচে ব্ল্যাক ফিল্ম লাগানো ছিল বলে নয়। ইনফ্যাক্ট অভিকের গাড়ি কয়েকদিন যে গ্যারাজে ছিল, মোনালিসার ভাই সেখানে গিয়ে ব্ল্যাক ফিল্ম সরিয়ে দিতে বলেছিল। এক্সসাইটমেন্টে অভীক বোধহয় তা খেয়াল করেনি।

Monday, 6 January 2020

স্টিমুলেশন

হাওড়ার অলিগলি ঘোরার শেষে এবার একটা গপ্পো তৈরী হয়েছে বোধ হচ্ছে।
বোটানিক গার্ডেন সোমবার বন্ধ। স্বাভাবিক। মানুষ কাজকর্ম করে। জ্যাঠামশাই সে বহু দূর দেশ এদেশে এসেছেন। সোম মঙ্গল মানছেন না। কলকাতার সব কিছুকে একেবারে চেখে নিতে চাইছেন প্রতিটি মুহূর্তএ। তা তার সোমবার কলকাতা চাখার ইচ্ছে হলেও, বাগান দেখার ইচ্ছে হলেও বাগানের মালিকের তো নিয়ম আছে। সোমবার বাগানে ঘোরা সাজে না। বাগানের সামনে গিয়ে সিকিউরিটির লাঠির ভয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে তৎক্ষণাৎ একটি উপায়ান্তর গন্তব্য ভাবতে হবে। স্টিমুলেশন চাই। কচুরি-আলুর বিকল্প নাই। কচুরির দোকানে পৌঁছনো গেলো।
কথায় কথায় জ্যাঠামশাই বললেন, হাওড়া আন্দুলে আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এসেছিলেন এক বন্ধুর বাড়ি। বন্ধু তখন রাজনীতি করেন। জ্যাঠামশাই ডাক্তারি পড়া শেষ করে প্র্যাক্টিসের চেষ্টা করছেন। সে বন্ধুর সাথে জ্যাঠামশাইএর কাটানো গল্প বলতে শুরু করলেন। সে বন্ধুর সাথে জ্যাঠামশাই রাতবিরেতে ট্যাংরাতে চ্যাংড়ামো করেছেন। সে বন্ধুর সাথে জ্যাঠামশাই শ্রীহরির সকালবেলার প্রথম কাগজের ঠোঙার কচুরি খেয়েছেন সে বন্ধুর সাথে জ্যাঠামশাই আরেকবন্ধুর বাড়ি গিয়ে বিকেল থেকে রাত অব্দি বন্ধুর মা কে বুঝিয়ে বন্ধুর বিয়ে দিতে রাজি করিয়েছেন। সে বন্ধুর সাথে জ্যাঠামশাই-এর শেষ দেখা চল্লিশ বছর আগে। ফোন নম্বর বদলেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আজ তাকে জ্যাঠামশাইএর মনে পড়েছে ভীষণ। এইটুকু শুনতেই আমি তাকালাম জ্যাঠামশাইএর দিকে আর জ্যাঠামশাই? আমার দিকে। হেসে বললেন, "বলছিস?" বললাম, "নিশ্চই, বাগানে যখন তালা ...... চলো খুঁজেই দেখি, আফসোস বড়ো ভয়ানক জিনিস, চেষ্টাটা তো হোক"।
প্রতি এক কিলোমিটার অন্তর চায়ের দোকান, টায়ার দোকান, হোমিওপ্যাথি সর্বত্র গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের প্রশ্ন, "আকাশ ভট্টাচার্য? রাজনীতি করতো? এই সোজা গিয়ে ডান দিকে কোথাও ..... বাবার প্রস্টেট ক্যান্সার হয়েছিল, বয়স সত্তর হবে। চেনেন?" আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রায় সবাই বললেন,"আকাশ? ভট্টাচার্য? দাদা পাড়ার নাম বলুন। ধুস। এভাবে হয় নাকি?" খুব বুদ্ধিমান একজন বললেন,"ফোন নম্বর আছে?" উনি বোধহয় ভেবেছেন আমাদের ফোন নেই। এসটিডি বুথ খুঁজছি।
প্রায় দুঘন্টা সারা রাস্তাতে বুলি পড়ার শেষে আমরা বুঝলাম চেষ্টারও সীমা থাকে। ওই সামনের চায়ের দোকানই সেই সীমা। চা খাই আর যদি খবর না পাই তাহলে এখানেই এ গল্পের শেষ। চা খাচ্ছি আর চা ওয়ালা আমাদের কান্ড শুনছেন। হঠাৎ চিৎকার করে ডাকলেন কাউকে। স্কুটারে বসা এক লোক এলেন, সবটা শুনলেন আর বললেন, "চা খেয়ে আসুন আমার সাথে"। জ্যাঠামশাই এর চোখ চকচক করে উঠলো। চা আর কে শেষ করে তখন! পাঁচ সেকেন্ডে ক্লাচে পা। স্কুটারের পিছন পিছন আমরা চললাম। বাম্পারে আর কোমড়ে তখন যুদ্ধ। স্কুটারওয়ালা কিছু দূরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছু লোক জড়ো করেছেন। তাঁরা এলেন আমাদের কাছে। আমরা আবার বুলি পড়লাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁরা বললেন," অমুক জায়গায় যান। কিছু খোঁজ মিলতে পারে।" আবার স্কুটার আর তার পিছন পিছন আমরা। সোমবার যেখানে বাগান বন্ধ, এই স্কুটারওয়ালা যে ভাবে আমাদের সময় দিচ্ছেন তা দেখে আমাদের মনে হলো, বন্ধুর দেখা না পেলেও মানবিকতার এই যে দৃষ্টান্ত পাওয়া, কিছু অংশে কম নয়। পিছন পিছন আমরা চললাম। এখানেও দেখা মিললো না। চললাম ডান দিকে। তারপর বাঁ। নাহ। মিলছে না। আমরা হাল ছেড়েছি। কিন্তু স্কুটার ব্যক্তি ছাড়েননি। এক স্থানীয় ব্যক্তির বাড়ি যাওয়ার উদ্যেশ্যে ঢুকেছি যে রাস্তাতে সেখানে চারজন পাশাপাশি গেলেই মেলা তৈরী হয়। সেরকম রাস্তাতে বড়ো ছোটো নানা গাড়ি, মানুষ, কুকুর, বিড়াল, কাক, ঢালা পিচ, গালাগালি আর হর্ন। যাকে বলে জমে ক্ষীর। কোনোরকমে ঢুকছি। আতঙ্কএ বুক দুরুদুরু, এ গলি থেকে বেড়োবো কিভাবে! এ গলিতে ইউ টার্ন নিতে পারেন একমাত্র রজনীকান্ত। অভিমন্যু ফিলিং নিয়ে এগোচ্ছি। ভদ্রলোক দাঁড়াতে বললেন। আমরা দাঁড়ালাম। পাঁচ মিনিট পড়ে ভদ্রলোক দৌড়ে এক গাল হেসে গাড়ির কাঁচের কাছে এসে বললেন, "বেরিয়ে আসুন। পেয়েছি"।
-হ্যা? বলেন কি? পেয়েছি মানে?
-হে হে পেয়েছি। আকাশবাবুর দাদা এনার বন্ধু। বহু পুরোনো বাসিন্দা এনারা। ইনিও রাজনীতি করতেন। তাই যোগাযোগ .....

তারপর বনেদি বাড়ির মুড়ি-চা, দুপুরের খাওয়ার ইনভিটেশন, আকাশবাবুর ছেলের হন্তদন্ত হয়ে আসা, আমাদের দেখে "এও সম্ভব" জাতীয় মুহূর্তের হা হওয়া, আমাদের তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া, আকাশবাবুর জ্যাঠামশাইকে জড়িয়ে ধরা, দুজনের আমাকে পাগলের মতো পুরোনো গল্প শেয়ার করা, স্কুটারওয়ালার চোখের কোণে জলের চিকচিক, আরও কত কি।

আমার চোখের সামনে আকাশ-বাতাস-সময়-মানুষ-ইমোশন সবাই মিলে একটা গপ্পো তৈরী করলো বটে।