Wednesday, 13 March 2019

নিউট্রোপিয়া


সে এক ভারী মজার দেশ। সে দেশে কেউ কাঁদে না। কেউ উচ্চস্বরে গালাগাল দেয় না। এমনকি কেউ জোরে জোরে হাসেও,  না কারণ তাতে আশেপাশের লোকজন চমকে যেতে পারে, বাচ্চা ভয় পেতে পারে, কাঁদতে পারে। এ দেশের রাস্তায়, লিফ্টে, ঘরে এমনকি বাথরুমেও ক্যামেরা। হ্যাঁ। নিরাপত্তার প্রয়োজনে। সবাই কি করছে, কি ভাবছে, কি বুঝছে, কি বুঝতে চাইছে সবটাই ওই দেশের রাজার দখলে। দেশের মানুষেরা তাই সবাই বেশ সংযত এবং নিয়ন্ত্রিত। ধর্ষণ তো দূরের কথা এখানে কারোর গায়ে টোকা মারলেই ওই এলাকা বরাবর একটা লাল আলো জ্বলে ওঠে আর সাথে সাথে ক্ষণক্ষণে একটা সাইরেন। টোকা মারা লোকটার ওপর স্পটলাইট পরে। তারপর পুলিশ এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তার বিচার হয়। কাউকে ছোঁয়া এখানে সমস্যাজনক বলে এবং সর্বত্র ক্যামেরা আছে বলে বিশেষ নিয়ম যৌনতার ক্ষেত্রে। যৌনতার জন্য রেজিস্ট্রেশন করাতে হয় সরকারের কাছে এই যেমন বিয়ের জন্য করে থাকি আমরা। সেই রেজিস্ট্রেশনের সময় একটি দিন ধার্য্য হয় যেদিন তার বাড়ির ক্যামেরা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ  থাকে। বিয়ে এখানে নিষিদ্ধ। সিগারেট-মদ-গাঁজা এসব যে যেখানে যখন ইচ্ছে খেতে পারে। টিভি সিরিয়াল আর নীল ছবির প্রচুর যোগান। কারোর যদি একটু কষ্ট-কষ্ট পায় কখনো বা কি যেন নেই কি যেন নেই ভাব আসে তার জন্য আছে একটা ছোট্ট ট্যাবলেট, যা সবসময় পকেটে রাখাই নিয়ম। সেটা খেয়ে নিলেই ব্যাস, ঘুম এসে যাবে কিছুক্ষনের জন্য। আর ঘুমলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রত্যেকেই এখানে সবসময় কিছু না কিছু করছেন আর নাহলে ঘুমোচ্ছেন। এখানে সবাই সচেতন এক একটি মেশিন। সবাই পরাধীন আর তাই সবাই সুখী। কারণ কেউ এখানে আলাদা করে ভাবে না, ভাবতে পারে না। কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না, কারণ তার যা চাই অর্থাৎ খাবার, যৌনতা, পোশাক, বাসস্থান সবই আছে বা চাইলে পাওয়া যায়। যেহেতু সবটাই নিয়মমাফিক তাই রাজা ছাড়া কেউ বেশি পেলো বা কম সেই রকম কোনো গরমিল নেই। তাই ঈর্ষাও নেই। বিয়ে নেই যে ওর বৌ বা বর বেশি সুন্দর তাই নিয়ে আক্ষেপ। তাই এই দেশকে চাইলে Sir Thomas More এর ইউটোপিয়া বলা যেতে পারে। সেই রূপকথার দেশের মতো যেখানে সবাই খুশি। বা রবি ঠাকুরের তাসের দেশ বলা যাতে পারে।
সংস্কৃতি এখানে কেউ বোঝে না কারণ তাতে ভাবনার প্রয়োজন।
কিন্তু হঠাৎ একটা পূর্ণিমা চাঁদ উঠলে কারোর মনে ভাবাবেগ এলে, কারোর যদি এই নিয়মের বাইরে যেতে ইচ্ছে করে, কারোর যদি কোনোরকম রেজিস্ট্রেশন ছাড়া এখন এই মুহূর্তে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, কারোর যদি মায়ের কোলে শুয়ে একটু ভানুর কমেডি শুনে চিৎকার করে হা হা করে হাসতে ইচ্ছে করে তাহলে? তাহলে সেটা বিদ্রোহ। তাহলে হয় তার শাস্তি হবে বা যদি বিদ্রোহ ব্যাপক মাত্রাতে হয় যখন হীরক রাজা নিজেই এসে নিজের মূর্তি ভাঙে, তখন ইউটোপিয়া ভেঙে সব আজকের মতো হয়ে যাবে।
আমরা তো সবাই ইউটোপিয়া চাই যেখানে সবাই খুশি কিন্তু তা ঠিক এইরকম আশা করিনা। সবকিছু একদম সঠিক, নিয়মমাফিক তাতে দমবন্ধ হয়ে আসে। স্বাধীনতা, এলোমেলো, ইচ্ছেমতো এসব জিনিস বড় সুস্বাদু, একবার পেলে ঠেকিয়ে রাখা মুশকিল। ওই দেশে তাই আমার আর যাওয়া হলো না। এই আমার নিউট্রোপিয়া তেই দিব্ব্যি আছি। একটা আলোর দিকে এগিয়ে চলার প্রত্যাশা নিয়েই এগিয়ে চলেছি। এই বেশ।

1 comment: