Monday, 20 November 2017

তুম তানা নানা

পরিস্থিতি হেবি থমথমে। জেঠুর মুখে কালি লেপে শ্রাবন্তীদি নাকি পালিয়েছে। কালি মুছতে সারা পাড়া উইথ পাড়ার ডাক্তার বাড়িতে হাজির। আমি আর দাদা স্কুল থেকে ফিরে খবর পেয়েই দৌড়ে কালি মোছা দেখতে গেলাম। কালি কোথায়! জেঠুর দিব্বি সেই ফর্সাটি। শুধু খাটে হেলান দেওয়া আর বুকে হাত। পাড়ার ডাক্তার বলছেন,"কালই ইসিজি করিয়ে নিন। কোনো নেশা নেই তো? এখনকার ব্যাথাটা আপনার স্ট্রেস থেকেই। বেশি চাপ নেবেন না" চারিদিকে সবার মুখ কালাপানির কয়েদিদের মতো। নিস্তব্ধতার কম্পেটিশন -এ পাড়ার দিদা-দাদুরা মাঝে মাঝে বাঁধ সাধলেও, মোটের ওপর একটা থমথমে ভাব ইন্ট্যাক্ট রাখতে সক্ষম হচ্ছেন সবাই। মাঝে মাঝে চপাট চপাট মশা মারার আওয়াজ। শ্রাবন্তীদির পালানো তবু সহ্য হবে,  কিন্তু ভয়ানক ডেঙ্গি? সে থেকে কে বাঁচাবে? কুঁইকুঁই করে জেঠু বলে উঠলেন,"কাছুয়া টা জ্বালাও না"
উপস্থিত সকলেই ঝটপট শশব্যস্ত হয়ে কাছুয়া খুঁজতে লাগলেন। পেলেনও। মুশকিল হলো, দেশলাই? নাই। জেঠিমার মুখ-এর পরিস্থিতি যা, তাতে বিনা দেশলাই-তেই আগুন লাগার সম্ভাবনা। তাই জেঠিমাকে কেউ ঘাটাতে চায় না। ঠিক এ অবস্থায়, দাদা বলে উঠল,"আরে দাদু, লাইটার তো তোমার পকেটেই"।

সবার মুখ এখন দাদার দিকে। ঠিক তখনি, কার মোবাইলে বেজে উঠলো,"আগুন লেগেছে লেগেছে লেগেছে আগুন তুম তানা নানা নানা"

Monday, 13 November 2017

চিরকুট চিৎপাত

ছাতাটা হারিয়েছি।
কোথায় রেখেছি মনে রাখতে না পারাকেই হারানো বলে, তাই না?
ছাতাটা হারিয়েছি এই ধরুন ছটা বর্ষা আগে। এ ক বছরে অবশ্য ছাতা হারিয়েছি এই স্মৃতিটাই হারিয়ে গেছিলো। মনে পড়লো এই একটা অদ্ভুত ঘটনাটাতে। গত ২৩ দিন ধরে ইতিহাস বইয়ের পাতায় রাখা একটি চিরকুট পাচ্ছি রোজ। তাতে লেখা,"আমি আছি, ইতি ছাতা"। প্রথম প্রথম ব্যাপারটাকে ছাতার মাথা বলে উড়িয়ে দিলাম। কিন্তু  ইতিহাস পড়া ইগনোর করাতে ওই সেদিন স্যারের কাছে প্রবল বকা খাই। বকা খেয়ে ইতিহাস বইটি খুলতেই আবার ওই চিরকুট। মাথাতে আগুন জ্বলে উঠলো। সমাধান এবার করতেই হচ্ছে। মা-বাবা-দিদি কে বলতে গেলাম। হিতে বিপরীত। বুঝলাম, সবার ওই ছবর্ষা আগের স্মৃতিটিকে উস্কে দিয়েছি। চিরকুটের উপস্থিতির থেকে ছাতাটির অনুপস্থিতিতে তাঁরা বেশি মর্মাহত। ফলস্বরূপ ছ-বছর আগে ছাতা হারানোর দিনটির যেন পুনরাবৃতি ঘটলো। সাথে বোনাস প্রাপ্তি- বাবার গুরুগম্ভীর জ্ঞান, ডালের হাতা হাতে মার হাই পিচ উপদেশ আর দিদির? খিল্লিমাখা হাসি। বিশেষ সুবিধা হলো না। সব আশা নিয়ে স্কুলে আমার আমার ডিটেক্টিভ বেস্ট ফ্রেন্ডকে এই ব্যাপারে বললাম। শুরুতেই ওর কথা কেন যে মাথায় আসেনি! যাই হোক, প্রথমেই শুরু করলাম সবকটা চিরকুট নিয়ে প্যাটার্ন বোঝা। উদ্ধার হলো দুটো জিনিস:
১. লেখাটা কারো একার নয়। ডিফারেন্ট হ্যান্ডরাইটিং
২. লেখা কালোকালি তে, কিন্তু শেড এক নয়

এর মধ্যে একটা চিরকুট নিয়ে বন্ধুটি বেশ সিরিয়াস। বললো,"চল বাড়িতে"। গেলাম। পরিস্কার চকচকে ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস নিয়ে এলো ওর দাদার ঘর থেকে। ওই চিরকুটের ওপর কিছুক্ষন ধরতেই চিৎকার করে উঠলো,"তোর দিদি থিয়েটারের স্ক্রিপ্ট লেখে, তাই না? ওরই কাজ মনে হচ্ছে রে। দেখ না চিরকুটের ওপর আবছা লেখা, ভূতের গপ্পো ৩। আমার মনে হয় এই চিরকুটটা যে পাতাতে লেখা তার আগের পাতাতেই এই গল্পের প্লটটা লেখা শুরু হয়েছিল। ডটপেনে চেপে লেখে বোধহয়, তাই ছাপ পড়েছে নিচের পাতায়। ভেবেছিলো, তুই এই চিরকুট দেখে ভয় পাবি, তাই তোর সাথে একটা রিয়েল এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছিলো।"
"জিও কাকা" বলে লাফিয়ে উঠলাম। ঠিকই তো, বাড়ির লোক ছাড়া রোজ রোজ আমার ঘরে ঢুকে এ কাজ কে করবে! আজ বাড়ি গিয়ে একটা দুর্দান্ত ক্লাইম্যাক্স মোমেন্ট যে ক্রিয়েট করবো, সে নিয়ে সন্দেহ নেই। উফফ ভেবেই রোমাঞ্চ জাগছে। মনে হচ্ছে এবার আমার ছাতা হারানোর দোষটা কাটবে।


খুশিতে ডগমগ আমি যখন বন্ধুটির সাথে সমাধান উদযাপন করছি, র দাদা পাশের ঘর থেকে ঢুকে বলে," তোপসে, আমার ম্যাগনিফায়িং গ্লাসটা  .... ও তোর হাতে। তোদের কাজ হয়ে গেলে দিয়ে যাস। আর শোন, বাড়িতে সন্দেশ আছে। চাই তো এখুনি ভিতরে যা দৌড়ে।" এই বোনাস সন্দেশ জিভের চারিধারে ঘুরঘুর করতে করতে বললো, মনে হয় দিদি এরকম কাজ বার বার করুক। ২১ রজনী সেনের এই বাড়ি আমার এই জন্য এতো ফেভারিট।

নীল পাঞ্জাবি কালো ধুতি

মেজোমামার বিয়েতে তার সঙ্গে প্রথম দেখা। না ঠিক দেখা নয়। আড়চোখে পলক ফেলে ফেলে নীল পাঞ্জাবি কালো ধুতি কে একটু বুঝে নেওয়া। কালো ধুতির চল সে সময় ছিল না। তাই সবার চোখই ছিল তার ওপর। নানারকম চাহুনি, যেমন “কি বোকা বোকা” “একি অদ্ভুত” “বাহ্ বেশ হাটকে তো” ছিল বটে। কিন্তু তাতে তাকে মোটেই অপ্রতিভ মনে হচ্ছিল না। বরং যেন একটু বেশিই স্বচ্ছন্দ। আর তাতে আড়চোখ আরও বেশি করে তাকেই খুঁজতে লাগলো। তার চোখ দু-একবার আমার চোখকে অ্যাকনোলেজ করেছিল বটে তবে খুব দ্রুত। ইতিমধ্যে এই পুরো সাইলেন্ট টেলিফিল্মটা কখন যে আমার ভাই ট্র্যাক করতে শুরু করেছে জানি না। মালা–‌বদলের ভিড়ে আমার কানের কাছে এসে বললো, “লাভ নেই। এনগেজড। আমাদেরই কোচিংয়ের মেয়ের সঙ্গে” । ড্যাম। চুরি করে ধরা পরে যাওয়া, তাও আবার সে চোরাই মাল যদি অকেজো হয়। ফিলিংসটা ঠিক কেমন হয় বলুন তো! যাক চোখাচুখি নিয়ন্ত্রিত হল তখুনি। সোনু নিগম হয়ে বিড়বিড় করলাম, জানা নাহি থা পিয়ার কি গলি মে।
===============
প্রায় ৭-৮ মাস পরে, অক্সিজেনে তখন পুজো পুজো গন্ধ। নতুন জামার মসমস, নতুন জুতোর ফোস্কা, পুরনো বন্ধুর হইচই, পুরনো রেস্টুরেন্টে নতুন মেনু, সব চলছিল নিজের তালে। উলটোদিকের টেবিলে আমাদের মতোই আরেক দল, একইরকম হুল্লোড়ে মত্ত। শুধু মুখগুলোই অচেনা ….. উহু একটা মুখ তো বেশ চেনা। আরিব্বাস। নীল পাঞ্জাবি কালো ধুতি যে। আজ সাদা শার্ট নীল ডেনিম। আর সঙ্গে সঙ্গেই মাথা বলে উঠলো, “না না, আর ও পথে না”। ব্যাস সোনু নিগম হয়ে বিড়বিড় করলাম, জানা নাহি থা পিয়ার কি গলি মে। কিন্তু ওপার থেকে ফোর জি নেটওয়ার্কের মতো শক্তিশালী চোখ যেন আমাকে ফলো করছে মনে হল। ইগনোর করতে, আরও বেশি করে মন দিলাম বিরিয়ানিতে। সবে দু-চামচ মুখে দিয়ে বিরিয়ানিতে মেডিটেশন শুরু করেছি, ওমনি “হাই, ডু উই নো ইচ আদার ….. ” সাদা শার্ট নীল ডেনিম আর তার দলবল, চোখের সামনে। কতক্ষণ হা করে ছিলাম মনে নেই। বাকি কী বলে গেল, মনে নেই। আলাপচারিতার শুরু। সুতপা কনুই-এর গুঁতো মেরে বলেছিল,”এই সেই? খবরদার। এনগেজেড কিন্তু।” এরকম সাবধান বাণী শুনে মনে হল, যেন ও সাবধান না করলে আমি যে কোনও মুহূর্তে সাদা শার্ট নীল ডেনিমকে জড়িয়ে ধরবো। আশ্চর্য্য। তা সেই সাবধানবাণীর ঠেলায় বা বিরিয়ানি কন্সেন্ট্রেশনে বাঁধা পড়ায়, আলাপচারিতাতে কন্সেন্ট্রেট করতে পারিনি। আমি মূলত শ্রোতাই হলাম। শেষে অবাক করে দিয়ে সুতপা হঠাৎ নবমীতে ম্যাডক্স স্কোয়ারের প্ল্যান বানিয়ে বসলো। সুতপাকে বুঝতে পারে কার সাধ্যি! আবার দেখা হওয়ার এক্সাইটমেন্ট যে আমার মধ্যে একেবারেই ছিল না তা বলা ভুল। মাস্কারা লাগালাম একটু ঘন করেই। না না, আর কিছু না। একটা প্রেজেনটেব্‌ল লুক তো দরকার, নাকি! তবে সুতপা-বুবাই দের সঙ্গে বেরোলে কেন এ কথা মনে হয় না! ওরা ছোট্টবেলার বন্ধু বলে! ম্যাডক্স স্কোয়ারের আড্ডা তখন চরমে, সাদা শার্ট নীল ডেনিম আমার কানে ফিসফিস করে বললো, “হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে। কাল একবার লেকে মিট করা যায়? সেই বিয়ে বাড়ি থেকে ট্রাই করছি। না বললে শুনবো না কিন্তু।” হার্টবিট ১১০। আচ্ছা এমন বুক চিনচিন করে কেন বলুন তো যখন মাথা আর মন ঝগড়া করে? মাথার শত অ্যালার্টকে মিথ্যে করে, দেখি না কী বলতে চায়, শুনতে মন চলল দশমীর বিকেলে, লেকের ধারে। পৌঁছনোর দু-কিলোমিটার আগেই এসএমএস, “নাহ সামনাসামনি বলার সাহস নেই। অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে। ক্যান ইউ হোল্ড মাই হ্যান্ড? ফর লাইফ?” মোবাইল থেকে চোখ তুলে মনে হল আশেপাশের কিছু লোক হা করে দেখছে আমায়? খেয়াল করলাম আমার মুখটা এক গাল হাসিতে ভরে গেছে কখন, আমার অজান্তেই! অক্সিজেনে এখন নীল পাঞ্জাবি কালো ধুতির গন্ধ। আশেপাশে লুকিয়ে আমায় দেখছে না তো? বাড়ি ফিরে ভাইকে একটা কিল মারবো ভাবছি।