Tuesday, 8 December 2020

নিশিকান্তর ভালোবাসা

 নিশিকান্ত ভালোবাসতে ভালোবাসে। অথচ প্রথম প্রেমে দড়াম ধাক্কা খেয়েছিল। প্রেমের কটা বছর কেটেছিল প্রতিমুহূর্তে ভালোবাসার মানুষকে ভেবে ভেবে। প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর সেই ভাবনাগুলোই ক্যাকটাসের তীক্ষ্ণ স্পাইনের মত বিঁধেছিল। দুটো পর্যায়ই গভীর। দুর্ভাগ্য নিশিকান্ত-এর মধ্যে আবেগের ভলিউম সাধারণের থেকে বেশি। বন্ধু, গান, বই, কাজ, পরিবার, রাস্তা, গাছ, আকাশ, দুর্গাপুজো, রবিবার, মদ, গাঁজা এত্ত কিছু তার জীবনে থাকলেও শুধু ওই প্রেম-প্রেম ব্যাপারটাই নিশিকান্তর জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন, তা কেউ বোঝে না! কাউকে ভালোবাসা আর কেউ তাকে ভালোবাসে এইটুকুর প্রত্যয়ই তো তার চাওয়া। এখন সোশ্যাল মিডিয়া আছে। তার মাধ্যমে বন্ধু পাওয়া একেবারে ঢেঁকুর তোলার মতো সহজ। কিন্তু এখন নিশিকান্ত একটু বড়ো হয়েছে। ছোট্টবেলার প্রেমটা তার যেমন তেমন কিভাবে যেন হয়ে গিয়েছিলো। এবার তো সে সচেতন। নিজের একটা চেকলিস্ট বানিয়েছে সে। সোশ্যাল মিডিয়ার মানুষজনকে নিশিকান্তর ভীষণ shallow মনে হয়। গভীরতা নেই। সবটাই রঙ চঙে মলাট। সবাই সব জানে। অথচ আঙ্গুল ডোবে না। নিশিকান্তর আরো বেশ কয়েকটা সমস্যা আছে, সে নিজের বয়সের ছেলেমেয়ের চেয়ে মানসিকভাবে একটু বেশিই বড়। নিজের গায়ের রং আর কাজকর্মের পরিধি নিয়ে হীনমন্যতা আছে। তার নিজের গুণ মানুষের কাছে বাড়িয়ে না বলে বরং লুকোনোর মহান গুণ আছে। সৎ হয়ে থাকার আর ভালোমানুষ হওয়ার বাতিক আছে। অর্থাৎ আজকের টিকে থাকার রেসে কোনোটাই এক্সেপটেবল ক্রাইটেরিয়া নয়। অতএব সঠিক মানুষের খোঁজ নিশিকান্ত পায় না। এভাবে দশ বছর কাটে। পাব, বালিগঞ্জ স্টেশন, গাঁজার ঠেক, মানসিক ডাক্তার, ওষুধ আর চায়ের দোকান ধীরে ধীরে আবছা হয়ে যাচ্ছে। নিশিকান্ত সব ছেড়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করবে ভাবছে সচেতন ভাবে। 

আর যখন চারিদিক বন্ধ, ছোট্ট পুঁচকে আলো এলো নিশিকান্তএর সোশ্যাল মিডিয়ার ফ্রেন্ড লিস্টে। যত আলাপ বাড়ে নিশিকান্তর মনে হয়, যেন এর জন্যই তার অপেক্ষা। চেকলিস্ট মাইল যাচ্ছে ম্যাজিকের মতো। সিনেমা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন। এরকম হয়না বাস্তবে। কিন্তু স্বপ্নটাই আরো বেশিক্ষণ দেখবে বলে নিশিকান্ত ডুব দেয় স্বপ্নসিন্ধুতে। এরপরের দিনগুলো একেবারে দুর্গাপুজোর মতো। পেটে প্রজাপতি, ইমোশনের চড়াই উৎরাই, রাগ-অভিমানের নাগরদোলা কি নেই। ধীরে ধীরে নিশিকান্ত সেই একেবারে হারিয়ে ফেলা প্রত্যয় খুঁজে পায় নিজের মধ্যে। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে নিশিকান্তর এখন খুব। জীবনটাকে এইবার যেন জীবন বলে মনে হচ্ছে নিশিকান্তর। এতদিন যেন শীতঘুমে ছিল। এভাবেই মধুযামিনী চললো এক্সপ্রেসওয়েতে একশো কুড়ি কিলোমিটার বেগে। সবকিছুর মত সেসব কাটতেই নতুন সমস্যা তৈরী হলো। নতুন মানুষের সাথে চাওয়া পাওয়ার সমস্যা। দুজনেই প্রত্যাশা ভালোবাসা, কিন্তু চাহিদা দুজনেরই, একই সময়ে, অনেকটা। কেউ একটু পিছু হটে আরেকজনকে সুযোগ দিতে চায় না। ভালোবাসাটুকুই তো চাই। তাতে আপোষ কেন! যুক্তির আইসবার্গ তৈরী হয়ে পোক্ত। সহজে তা গলে না। শেষে কান্নাকাটি, ভাঙ্গাভাঙ্গি। নিশিকান্ত ভালোবাসা চেয়েছিল। কিন্তু মৌলিক পদার্থ নিয়ে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। শুধুই পেটে প্রজাপতি ভালোবাসা নয়। ধৈর্য্য, সময়, আপোষ, নিয়ন্ত্রণ, অনু পরমাণু এসব যে এতো গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝেনি নিশিকান্ত। এখন নিশিকান্তর সব আছে। কিন্তু শান্তি? স্থিরতা? হারমোনি?  



Wednesday, 13 May 2020

এনিমেটর

সার্গে মস্কোভিচ এই কিছুবছরে কার্টুন এনিমেশনে কাজ করে হলিউডে ভারী ওজনের নাম করে ফেলেছেন। তাঁকে এনিমেটর হিসেবে পেলে সিনেমার কমার্শিয়াল বেনিফিট নিয়ে নিশ্চয়করণই হয়ে যায়। শুধু মানুষ নয়, গাড়ি, বাড়ি, মোবাইল, গাছ এমনকি রান্নার বাসনকেও কার্টুন বানিয়ে দর্শকের চিত্ত বিনোদন করেছেন সার্গে। সকলে ওনাকে ট্র্যাজিক এনিমেটর বলে। কারণ তাঁর গল্পের শেষে চমক থাকে। ট্র্যাজিক বুক হিম করা চমক, যার ইমপ্যাক্ট দর্শকের ওপর থাকে অনেকক্ষন।
বহুদিন পর সার্গে আবার হিউমান কার্টুন নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। শুরুতেই স্কেচগুলো রেডি। গল্পের লাইন আপের সাথে আপাতত ফিট। এবার স্প্লিনিং এর কাজ শুরু। প্রেমের গল্প। মাঝে খানিক অ্যাকশন। ট্র্যাজিক এন্ডিং - মেয়েটি ছেলেটিকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য দেশে। সবকটা লেয়ার শেষ করতে বহুদিন লাগলো। গতরাতেই শেষ লেয়ারে কাজ করেছেন। আজ ঘুম থেকে উঠতে সার্গের অনেক দেরি হলো। এরকম দেরি হলে অবশ্য সার্গের দিব্বি লাগে। কফি খেতে খেতে অনিয়মের দুপুর পেরোয়। বিকেলে বসলেন স্মুথিংয়ের কাজ করতে। শেষ লেয়ারগুলোতে হঠাৎই চোখ পড়লো। এরকম ঝকঝকে রং ছিল না বলেই মনে পড়ে সার্গের। বিদায়বেলা মানেই সমবের টাচ, হালকা নীল। কিন্তু এতো লাল রং। এরকম ভুল তো সার্গের হওয়ার কথা নয়। তা যদি হয়ও, ছেলেটি খিলখিলিয়ে হাসছে? কি করে সম্ভব। কালই তো ছেলেটির ফেস এক্সপ্রেশনের ইম্পেরফেকশন কারেকশন করলেন সার্গে। ছেলেটির থাকবে স্যাড এক্সপ্রেশন। তার বদলে হাসি! প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ফোন করলেন সালভাদরকে। বন্ধু, সহকর্মী, প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটি মানুষ। ঠিক এই সময় যাকে ভীষণ প্রয়োজন সার্গের। বন্ধু শুনে বললেন, গাঁজা ছাড়া এরকম দুঃসাহসিক কান্ড করানোর ক্ষমতা আর কারোর নেই। কথা বলে সার্গের মনটা ঠিক হলো সামান্য। কিন্তু গাঁজা খেয়ে মাউসে হাত দিয়ে ক্লাইম্যাক্স দিয়েছেন সার্গে এর আগে বহুবার। শুধুমাত্র গাঁজার পরাক্রমে এতো ভুল, স্বাভাবিক লাগছে না সার্গের। তবে বয়সের আক্রমণ ভেবে সার্গে ব্যাপারটাকে আপাত অগ্রাহ্য করে কাজে মন দিলেন। ফাইনাল সেভিংএর সময় ভালো করে দেখে একটা নোট রাখলেন "রেভিউড"।
মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো সার্গের। জল খেতে উঠলেন। চোখ পড়লো কম্পিউটারে। স্ক্রিন অন। অফ করেই শুতে গিয়েছিলেন সার্গে। এতো ভুল একসাথে হতে পারেনা। লেয়ারগুলোতে চোখ বোলাতেই হবে। আবার কিছু পিকুলিয়ার  ..... না আপাতত ঠিকই আছে। একদম শেষে এসে আবার ...... ড্যাম। আবার শেষের লেয়ারগুলোতে ঝকঝকে রং। ছেলেটা? হ্যা, আবার সেই হাসি মুখ। এইতো রেভিউয়েড নোট ওয়ালা ফাইল। এরপরেও এই রং, এতো পার্থক্য! ভুল নয়। ভুল নয়। কোথাও কিছু সমস্যা হচ্ছে। কিছু হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে আবার কখন সার্গে ছবি কারেক্ট করতে শুরু করলেন নিজের অজান্তেই। কিন্তু সব গুলিয়ে যাচ্ছে। নাহ ঠিক করলেন কাল সকালে দেখবেন। সেরকম কিছু গন্ডগোল হলে সালভাদরকে ডেকে নেবেন না হয়। ঘুম হলো না। তন্দ্রা ছিল। সূর্যের আলোর অপেক্ষা ছিল। অনেক শক্তি নিয়ে ফাইল খুলতেই আবার সেই। এবার যেন পাগল হয়ে যাবেন সার্গে। ইনসেন। টেকনিক্যালি সব নিখুঁত। কিন্তু গল্পের ক্লাইম্যাক্স ঘেটে যাচ্ছে যে।     
লেয়ার গুলো খুঁটিয়ে দেখছেন সার্গে। সব ঠিকই রয়েছে। ঠিক শেষ দৃশ্যে যখন মেয়েটির চলে যাওয়ার কথা, সেখানে সে দৌড়ে আসছে, ফিরছে। ঝকঝকে রং চারিদিকে। আলোয় আলো। ছেলেটি হাসছে। চোখে মুখে ভাস্করতার প্রভা। কিভাবে এসব হচ্ছে! কার্টুন ক্যারেক্টার নিজেরাই কন্ট্রোল করছে! ও কি সম্ভব! এরকম হলে চলে না। পাবলিক দুঃখ গেলে। মার্কেটে সেটাই চলে। এ জিনিস কেউ দেখবে না। সার্গে হঠাৎ অসহায় বোধ করছেন। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোলেন টানা ০৩ দিন। শেষে এই ফাইলটাই দিয়ে দিলেন প্রোডাক্শনকে। গল্পের সাথে মেলেনি এরকম একটি কাজ দিলে প্রোডাক্শনের কাছ থেকে যে হেনস্তা হতে হবে তা মেনে নেওয়ার শক্তি নেই সার্গের। যেখানে নিজের বিচার বুদ্ধির ওপরেই জোর নেই। নিজের হাতের ওপরেই ভরসা নেই। যা হচ্ছে, তার কোনো যুক্তি নেই। সেখানে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন না সার্গে। উধাও হয়ে গেলেন হঠাৎ। লোকে বলে মেক্সিকোর কোনো গ্রামে আছেন। বাচ্চাদের অ্যানিমেশন সেখান। খুশির অ্যানিমেশন। হাসির।
ওনার শেষ কাজ যার এন্ড ট্রাজিক, তা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলো। ওনার থেকে ট্রাজিক এন্ডিং এক্সপেক্ট করে দর্শক যখন হ্যাপি এন্ডিং দেখলো, চমকটা সেইখানেই হয়ে গিয়েছিলো।
ওই এনিমেশনের শেষে লেখা ছিল, সার্গে, টি এন্ড অফ ট্রাজেডি। 

Friday, 27 March 2020

তাইজিতু

দেখলাম এক বন্ধুস্ত্রী হাতে একটি ট্যাটু করিয়েছেন। একটি প্রতীকী। জিজ্ঞেস করাতে একটু খাবি খেলেন। বললেন, ও ওই ওই আর কি, ওই মানে ব্যাপারটা কুল, তাই আর কি  ......
তা "কুল"র টেস্ট সবসময়ই ভালো। সরস্বতী পুজোর পর তা একটু বরং বেশি। তাই টেস্ট করতে একটু খোঁজাখুঁজি করেই ওই "কুল" প্রতীকীটির ব্যাপারে জানা গেলো।
কাকতালীয় ব্যাপার মশাই, আজ যখন চীনে ব্যাপার নিয়ে সারা পৃথিবী বেশ সরগরম, প্রতীকটিও চিনে। চীনা ঐতিহ্যবাহী ‘তাইজিতু’ (Taijitu) প্রতীক (ছবি সাঁটানো)। এই প্রতীকের একপাশ অন্ধকার বা কালো (ইন), অন্য পাশ আলোকিত বা সাদা (ইয়াং)।
"ইন" আর "ইয়াং" এর কথা নিয়ে কোটি লেখা থিক থিক করছে ই-জগতে। ছোট করে বলতে গেলে, চাইনিস "টাও" ফিলোসফি মতে,  ইন মানে মুন, ইয়াং মানে সান। ইন মানে ঢাকা, ইয়াং মানে খোলা। ইন মানে মহিলা, ইয়াং মানে পুরুষ। আর উভয় মিলেই এই ইউনিভার্স। একে অপরকে ছাড়া কিছুই নয়। খুবই জানা তথ্য। নতুন কিছু নয়। অর্ধনারীশ্বর কনসেপ্ট তো আমাদের ঘরের। এ নিয়ে সবাই আমরা সুজ্ঞানী। কেউ বলতে বললেই চার নম্বরের সারাংশ নেমে যাবে চোখের পলকে। হোঁচট খেলাম যখন আরও পড়ছি আর বুঝছি চাইনিস মত অনুযায়ী ইন মানে নেগেটিভ, আর ইয়াং মানে পসিটিভ। ইন মানে প্যাসিভ, অন্ধকার, কালো আর ইয়াং মানে একটিভ, আলো মানে সওওওওওব ভালো। ইউনিভার্সের সাদা কালো, অন্ধকার আলোর কন্সেপ্টে মহিলাদের ওই অন্ধকারের সাথে যোগে আমার বড় ধাঁধা।মহিলাদের নেগেটিভ বলে যে মহান কান্ড চাইনিস এনসেস্টররা করেছেন, আজকের চাইনিসরা তার প্রতিবাদ করেন যদিও। তারা জেন্ডার ইকুয়ালিটিতে বিশ্বাস করেন। তথাপি মধ্যযুগীয় কাল থেকে মহিলাদের এই যে নঞর্থক ভাবার প্রবণতা তা অন্য দেশেও স্পষ্ট। ১৪ থেকে ১৮ শতকে মহিলাদের দ্বারা কোনো ব্যাভিচারের অভিযোগ আসলে, শাস্তি হিসেবে আবিষ্কার হয়েছিল এক যন্ত্র যাকে "ব্রেস্ট রিপার" বলে (ছবি সাঁটানো)। এই যন্ত্র দিয়ে তাদের ব্রেস্ট ছিড়ে নেওয়া হতো। নানা এক্সপেরিমেন্ট এও দেখা গেছে, সুযোগ পেলে শান্ত নিরীহ পুরুষও মহিলাদের শরীরের সুযোগ নিয়েছেন। শেক্সপীয়ারের গল্প অনুযায়ী,  শ্রীউ বলে অবিহিত করা হতো স্পষ্টভাষী মহিলাদের, যাদের সামাজিকভাবে নেতিবাচক চোখে দেখা হতো। এথেন্সে ডেমোক্রেসি শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, তবু মহিলাদের মা হিসেবে দেখাই অর্থাৎ সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং তাদের লালন করাই একমাত্র কাজ বলে মনে করা হতো। ঋগ্বেদ যুগ বাদ দিলে ভারতবর্ষে মহিলাদের ইনইকুইলিটিও সবারই জানা।
যদিও আজ চিত্র অন্য। তার জন্য পুরুষদের সুচেতনাকে ধন্যবাদ।

কিন্তু কথা হলো, বন্ধুস্ত্রী, যিনি এই প্রতীকটিকে বহন করে চলেছেন, তাকে নিয়ে আমার বড়ো দুশ্চিন্তা। কুল দেখাতে গিয়ে মস্ত ভুল করেননি তো?





Tuesday, 18 February 2020

ডেথ ড্রাইভ

ধরে আছে? নাকি ছেড়ে দিতে চাইছে?
এসব ভাববো না কল করবো পুলিশ? ইমিডিয়েট হেল্প?
বেশ কিছু লোকও ততক্ষনে জড়ো হয়েছে আসে পাশে। সবাই হা করে ওপরে তাকিয়ে। সবার মুখে ভয় আতঙ্ক। এদিক ওদিক দেখছেন। কেউ কি কল করেছে অলরেডি পুলিশে? হেল্প কি আসছে? কেউ কেউ চিৎকার করে বলছে, হেই। আর ইউ ক্রেজি? হোল্ড অন। ডোন্ট ডোন্ট ডোন্ট ডু দিস ম্যান। একজন বয়স্ক মহিলা বিড়বিড় করছেন। বোধহয় ঈশ্বরকে ডাকছেন।
হঠাৎ একজন হেসে উঠলো। সাথে সাথে একটা চাপা হিসহিস, ফিসফিস। আর ছোঁয়াচে হাসি একটু একটু করে সবাইকে কব্জা করলো। আরে ফাইবারগ্লাসের একটা স্ট্যাচু যে।
আজ্ঞে। চেকরিপাব্লিকের প্রাগ শহরের স্টেয়ার মেস্তো অর্থাৎ ওল্ড টাউনে এই স্ট্যাচুটি আসলে ট্যুরিস্টদের জন্য একটা চমক।
----------------------------------------------------------------------------------------------
সিগমান্ড ফ্রেউড ছিলেন একজন সাইকোএনালিস্ট। সাইকোএনালিসিস্ শব্দটির জন্মদাতা এই ব্যক্তি নানা চিকিত্সাবিদ্যাগত আবিষ্কার করেছেন মানুষের সাইকিক নেচারের নানা ক্ষেত্রে যেমন বিষাদ, ইগো, স্বপ্ন এমনকি থানাটোস অর্থাৎ মৃত্যুর চালক ইত্যাদিতে। নিউরোলজিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। প্রায় আশি বছর বয়সে তিনি যখন জীবনের শেষ পর্যায়ে, তখন তাঁর খ্যাতি এবং জন্মসূত্রে ইহুদি সংযোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মানসিক-শারীরিক অত্যাচার সহ্য করেন। তাঁর নিজের লেখা মূল্যবান তথ্য পুড়িয়ে দেওয়া হয় চোখের সামনে। নিরুপায় হয়েই পালিয়ে যেতে হয় লন্ডনে। শেষের সে দিন তখন ভয়ঙ্কর রিফুজি অবস্থায় কাটছে যখন, ধরা পড়লো ক্যান্সার বীজ শরীরে জাঁকিয়ে বসেছে। সমস্তটা জীবনে নানা মানুষের আতঙ্ক, সাবকন্সসিয়াস মানসিক অবস্থা নিয়ে এনালাইসিস করা ব্যক্তি নিজেও ভয় পেয়েছেন বহুবার নিজেকে নিয়ে। আতঙ্কে থেকেছেন। মনে হয়েছে জীবনকে ধরে রাখবেন নাকি হাল ছেড়ে দেবেন। শেষে যখন অসুস্থতা চরমে, খাওয়া বন্ধ হলো, কথা বলাও, নিজের মৃত্যুর ভয়ে প্রতিদিন মরছিলেন পলে পলে। সিদ্ধান্ত নিলেন মরফিনের হাই ডোসে মৃত্যুবরণ করবেন তাঁর ডাক্তার বন্ধুর সাহায্যে। হলোও তাই। প্ল্যান মাফিক কাজ।

প্রাগের মূর্তিটি তাঁর ওই মানসিক অবস্থাকে উৎসর্গ করেই, ধরে রাখবেন নাকি জাস্ট ছেড়ে দেবেন!

Saturday, 25 January 2020

পার্কসার্কাসের সার্কাস

হুন্ডাই থেকে হন্ডা মেয়ে টানে বেশি। অভীক এর প্রতিটি উইকেন্ড হন্ডা কেনার পর থেকে জব্বর কাটছে। কলেজের সিনিয়র - জুনিয়র এরা তো ছিলই। এখন সানন্দার কভার মডেলরাও ইসি। আর তাছাড়া আজকাল সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আনসোশাল হওয়াটা অনেক বেশ সহজ। তার ওপর বিংশ শতাব্দীর সুবিধা হলো, ইনিয়ে বিনিয়ে প্রেমের কথা বলে গাড়িতে ডাকতে হয় না। হন্ডা, আর সাথে সমপ্লেসএলসের অফার পেলেই ব্যাপারটা স্মুথ। গাড়ির কাঁচে ব্ল্যাক ফিল্ম লাগানোটা বেআইনি। অভীক এর তাতেই ডেয়ারিং হওয়ার এডভেঞ্চার। ফিল্ম লাগানো কাঁচের গাড়ি থাকলে, বাইরের লোকজন ভিতরের কিছু দেখতে পায় না। তাতে বান্ধবীকে বাড়িতে ডেকে এনে ঝামেলা বাড়ানোর চাপ নেই। জীবনে ফ্লেক্সিবিলিটি খুব দরকার। এই যুগের ছেলেমেয়েরা সবাই খুব ফ্লেক্সিবল। সরস্বতী পুজোর পর কুল খাওয়া দিন গন। এখন সবাই "কুল"। তাতে মাঝে মাঝে এক দুটো ভুল হয় বটে। কিন্তু সেসব ভেবে উইকেন্ড খারাপ করা যায় না। এরকম বেশ কয়েকটা উইকেন্ড কুল অভীক, কুল মোনালিসার সাথে কোলাকুলি কাটিয়ে নেওয়ার পর, যখন পাশ কাটিয়ে সোনা আর লিসাদের দিকে ঝুঁকছে, মোনালিসা এ জিনিস মেনে নিতে পারছে না। কুল হতে গিয়ে ইমোশনাল ভুল হয়ে গেছে। এইখানে হয়ে যায় সমস্যা। ফ্লেক্সিবিলিটির মজা নিতে নিতে আজকের সোনা-মনারা ভুলে যায় যে বেশি টানাটানি করলে ফ্লেক্সিবিলিটি টুং করে ছিঁড়ে যেতে পারে, অন্তত সম্ভাবনা থেকেই যায়। অনুনয়, বিনয়, আবেগ, ভালোবাসা, মোহ আর নানা রকম হাতিয়ারেও কাজ না হতে মোনালিসা প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকে। তাতে অভীকের কিছু যায় আসে নি।
মোনালিসার ভাই কয়েকটা উইকেন্ড অভীককে ফলো করে দেখে নিয়েছে উইকেন্ডে হন্ডা কোথায় কোথায় যায়। গাড়ি চাঁদনীচক থেকে পার্কস্ট্রিট আসে। সেখান থেকে "জলযোগ" হয় তারপর পার্কসার্কাসে গাড়ি বেশ কিছুক্ষন দাঁড়ায়।
থার্টি ফার্স্ট। গাড়ি আজ অনেক বেশি চনমনে। হন্ডা গ্যারাজ থেকে এসেছে আজই আরও ধোপদুরস্ত হয়ে নতুন চকচকে রঙে। বান্ধবীর সাথে অভীকের এক্সসাইটমেন্টের লেভেলটাই আজ মধ্যগগনে। গাড়ি চাঁদনীচক, পার্কস্ট্রিট হয়ে এখন পার্কসার্কাসে দাঁড়িয়েছে দশমিনিট। আশেপাশের লোকজন একটু বেশিই দেখছে আজ গাড়িটাকে।
ঠোঁটে চুমু, বিয়ারে চুমু, নেশা তখন টানটান। গাড়িতে নক, হালকা তারপর জোড়ে, ভীষণ জোড়ে, ভীষণ রকম জোড়ে। পুলিশ।
========
অভীক এখন পুলিশের কাস্টডিতে। নাঃ গাড়ির কাঁচে ব্ল্যাক ফিল্ম লাগানো ছিল বলে নয়। ইনফ্যাক্ট অভিকের গাড়ি কয়েকদিন যে গ্যারাজে ছিল, মোনালিসার ভাই সেখানে গিয়ে ব্ল্যাক ফিল্ম সরিয়ে দিতে বলেছিল। এক্সসাইটমেন্টে অভীক বোধহয় তা খেয়াল করেনি।

Monday, 6 January 2020

স্টিমুলেশন

হাওড়ার অলিগলি ঘোরার শেষে এবার একটা গপ্পো তৈরী হয়েছে বোধ হচ্ছে।
বোটানিক গার্ডেন সোমবার বন্ধ। স্বাভাবিক। মানুষ কাজকর্ম করে। জ্যাঠামশাই সে বহু দূর দেশ এদেশে এসেছেন। সোম মঙ্গল মানছেন না। কলকাতার সব কিছুকে একেবারে চেখে নিতে চাইছেন প্রতিটি মুহূর্তএ। তা তার সোমবার কলকাতা চাখার ইচ্ছে হলেও, বাগান দেখার ইচ্ছে হলেও বাগানের মালিকের তো নিয়ম আছে। সোমবার বাগানে ঘোরা সাজে না। বাগানের সামনে গিয়ে সিকিউরিটির লাঠির ভয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে তৎক্ষণাৎ একটি উপায়ান্তর গন্তব্য ভাবতে হবে। স্টিমুলেশন চাই। কচুরি-আলুর বিকল্প নাই। কচুরির দোকানে পৌঁছনো গেলো।
কথায় কথায় জ্যাঠামশাই বললেন, হাওড়া আন্দুলে আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এসেছিলেন এক বন্ধুর বাড়ি। বন্ধু তখন রাজনীতি করেন। জ্যাঠামশাই ডাক্তারি পড়া শেষ করে প্র্যাক্টিসের চেষ্টা করছেন। সে বন্ধুর সাথে জ্যাঠামশাইএর কাটানো গল্প বলতে শুরু করলেন। সে বন্ধুর সাথে জ্যাঠামশাই রাতবিরেতে ট্যাংরাতে চ্যাংড়ামো করেছেন। সে বন্ধুর সাথে জ্যাঠামশাই শ্রীহরির সকালবেলার প্রথম কাগজের ঠোঙার কচুরি খেয়েছেন সে বন্ধুর সাথে জ্যাঠামশাই আরেকবন্ধুর বাড়ি গিয়ে বিকেল থেকে রাত অব্দি বন্ধুর মা কে বুঝিয়ে বন্ধুর বিয়ে দিতে রাজি করিয়েছেন। সে বন্ধুর সাথে জ্যাঠামশাই-এর শেষ দেখা চল্লিশ বছর আগে। ফোন নম্বর বদলেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আজ তাকে জ্যাঠামশাইএর মনে পড়েছে ভীষণ। এইটুকু শুনতেই আমি তাকালাম জ্যাঠামশাইএর দিকে আর জ্যাঠামশাই? আমার দিকে। হেসে বললেন, "বলছিস?" বললাম, "নিশ্চই, বাগানে যখন তালা ...... চলো খুঁজেই দেখি, আফসোস বড়ো ভয়ানক জিনিস, চেষ্টাটা তো হোক"।
প্রতি এক কিলোমিটার অন্তর চায়ের দোকান, টায়ার দোকান, হোমিওপ্যাথি সর্বত্র গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের প্রশ্ন, "আকাশ ভট্টাচার্য? রাজনীতি করতো? এই সোজা গিয়ে ডান দিকে কোথাও ..... বাবার প্রস্টেট ক্যান্সার হয়েছিল, বয়স সত্তর হবে। চেনেন?" আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রায় সবাই বললেন,"আকাশ? ভট্টাচার্য? দাদা পাড়ার নাম বলুন। ধুস। এভাবে হয় নাকি?" খুব বুদ্ধিমান একজন বললেন,"ফোন নম্বর আছে?" উনি বোধহয় ভেবেছেন আমাদের ফোন নেই। এসটিডি বুথ খুঁজছি।
প্রায় দুঘন্টা সারা রাস্তাতে বুলি পড়ার শেষে আমরা বুঝলাম চেষ্টারও সীমা থাকে। ওই সামনের চায়ের দোকানই সেই সীমা। চা খাই আর যদি খবর না পাই তাহলে এখানেই এ গল্পের শেষ। চা খাচ্ছি আর চা ওয়ালা আমাদের কান্ড শুনছেন। হঠাৎ চিৎকার করে ডাকলেন কাউকে। স্কুটারে বসা এক লোক এলেন, সবটা শুনলেন আর বললেন, "চা খেয়ে আসুন আমার সাথে"। জ্যাঠামশাই এর চোখ চকচক করে উঠলো। চা আর কে শেষ করে তখন! পাঁচ সেকেন্ডে ক্লাচে পা। স্কুটারের পিছন পিছন আমরা চললাম। বাম্পারে আর কোমড়ে তখন যুদ্ধ। স্কুটারওয়ালা কিছু দূরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছু লোক জড়ো করেছেন। তাঁরা এলেন আমাদের কাছে। আমরা আবার বুলি পড়লাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁরা বললেন," অমুক জায়গায় যান। কিছু খোঁজ মিলতে পারে।" আবার স্কুটার আর তার পিছন পিছন আমরা। সোমবার যেখানে বাগান বন্ধ, এই স্কুটারওয়ালা যে ভাবে আমাদের সময় দিচ্ছেন তা দেখে আমাদের মনে হলো, বন্ধুর দেখা না পেলেও মানবিকতার এই যে দৃষ্টান্ত পাওয়া, কিছু অংশে কম নয়। পিছন পিছন আমরা চললাম। এখানেও দেখা মিললো না। চললাম ডান দিকে। তারপর বাঁ। নাহ। মিলছে না। আমরা হাল ছেড়েছি। কিন্তু স্কুটার ব্যক্তি ছাড়েননি। এক স্থানীয় ব্যক্তির বাড়ি যাওয়ার উদ্যেশ্যে ঢুকেছি যে রাস্তাতে সেখানে চারজন পাশাপাশি গেলেই মেলা তৈরী হয়। সেরকম রাস্তাতে বড়ো ছোটো নানা গাড়ি, মানুষ, কুকুর, বিড়াল, কাক, ঢালা পিচ, গালাগালি আর হর্ন। যাকে বলে জমে ক্ষীর। কোনোরকমে ঢুকছি। আতঙ্কএ বুক দুরুদুরু, এ গলি থেকে বেড়োবো কিভাবে! এ গলিতে ইউ টার্ন নিতে পারেন একমাত্র রজনীকান্ত। অভিমন্যু ফিলিং নিয়ে এগোচ্ছি। ভদ্রলোক দাঁড়াতে বললেন। আমরা দাঁড়ালাম। পাঁচ মিনিট পড়ে ভদ্রলোক দৌড়ে এক গাল হেসে গাড়ির কাঁচের কাছে এসে বললেন, "বেরিয়ে আসুন। পেয়েছি"।
-হ্যা? বলেন কি? পেয়েছি মানে?
-হে হে পেয়েছি। আকাশবাবুর দাদা এনার বন্ধু। বহু পুরোনো বাসিন্দা এনারা। ইনিও রাজনীতি করতেন। তাই যোগাযোগ .....

তারপর বনেদি বাড়ির মুড়ি-চা, দুপুরের খাওয়ার ইনভিটেশন, আকাশবাবুর ছেলের হন্তদন্ত হয়ে আসা, আমাদের দেখে "এও সম্ভব" জাতীয় মুহূর্তের হা হওয়া, আমাদের তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া, আকাশবাবুর জ্যাঠামশাইকে জড়িয়ে ধরা, দুজনের আমাকে পাগলের মতো পুরোনো গল্প শেয়ার করা, স্কুটারওয়ালার চোখের কোণে জলের চিকচিক, আরও কত কি।

আমার চোখের সামনে আকাশ-বাতাস-সময়-মানুষ-ইমোশন সবাই মিলে একটা গপ্পো তৈরী করলো বটে।