Thursday, 30 March 2017

ভালোবাসার মার্কেট ভ্যালু

গতবছর স্বামীটি তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, বিয়ে করেছে অন্য কাউকে। আর তার পর থেকেই নাকি মেয়েটির সাজসজ্জ্বার বহর বেড়েছে। পাড়ায় কানাঘুষো যে, আবার মেয়ে বিয়ে করবে তাই.... হাতে চুরি একটার থেকে বেড়ে দুটো-তিনটে। মাথায় ফুল, কখনো গয়না। শাড়িটা নাকি আজকাল উঁচু করে পড়ে। সাইকেল চালিয়ে যখন কাজে যায়, এদিক ওদিক তাকায়, বোধহয় পুরুষ খোঁজে। এমন তখন তার চাউনি, যে দেখবে সে বশীভূত হয়ে যাবে। কথা বলে যখন, কোমড়ে হাত দিয়ে ন্যাকামো করে। রাত-বিরেতে একা একা ঘুরে বেড়ায়, নোংরা পাড়ায় যায় কিনা কে জানে? আসলে পুরুষের মন ইলাস্টিকের মতো, টানতে হয়। আজকাল সাজের বহরে অনেকেই উঁকিঝুঁকি মারে বটে। তাতে মেয়েটির বেশ মজা লাগে। ভালোবাসতে মেয়েটির বেশ লাগে। ভালোবাসার কথা শুনলে বুক ঢিপঢিপ করে, শিহরণ জাগে। এই তো সেদিন পূর্ণিমায় ছেলেটি মাতাল হয়ে কত্ত ভালোবাসার কথা বললো। শেষে বিয়ের কথা অব্দি বলে বসলো। এটাই তো চাইছিলো মেয়েটি, খুশিই তো হওয়ার কথা। কিন্তু কিরকম যে সব গুলিয়ে গেলো, কেমন পচা গন্ধ চারিদিকে। সব নেশা উড়ে গেলো যেন। ছেলেটি তখনও ঘ্যান ঘ্যান করছে। ছেলেটিকে "না" বলে ছেড়ে আসতে কি যে আনন্দ হচ্ছিলো। ছেলেটি এখন দেখলেই দৌড়ে পালায়।
কেন এরকম?
এই ফাগুনে পাশের পাড়ার বুড়ো মাস্টারও খুব কদিন পিছু পিছু। সুন্দর সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি কত কথা। বলে নাকি ওগুলো কবিতা। মেয়েটির মাথায় কিছু ঢোকেনি, কিন্তু শুনতে বেশ লাগছিলো। মাসখানেক চলেছিল এই খেলা। মাঝে একদিন হাত বাড়ালো এদিক ওদিক, কিন্তু মেয়েটির চাহনিতেই সে হাতের উন্মাদনা শাসিত হলো। বোধহয় সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তাই রাতে ডাকলো চাঁদপুরের বনে। মেয়েটির কোনো ভয় নেই যেন। চলে গেলো একাএকা। গান হলো, নাচ হলো, নেশা হলো, হঠাৎ মাস্টার বলে বসলো," চল বিয়ে করি, এই সব যারা আমাদের দেখছে, ওই পলাশ, ওই আফ্রিকান টিউলিপ, ওই পান্থপাদপ, দেখ কিরকম দুলছে, সায় দিচ্ছে আমাদের কথায়, ওদের সাক্ষী করে চল বিয়ে করি". অমনি পচা পচা গন্ধ, মদটাতে কে যেন বিষ-তিতো ঢেলে দিয়েছে। তারপরের কথা মনে নেই মেয়েটির। শুধু মনে আছে যে, বাড়ি ফিরে আসতে আসতে খুব মজা লেগেছিলো, খুব হাসছিলো মেয়েটি। পরের দিন ডাক্তারের একটি দল এলো শহর থেকে। মেয়েটিকে নিয়ে গেলো তাদের সাথে।

ডক্টর রায় এই গল্পটা আমাকে বলে। মেয়েটির নাকি মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার। মাস্টারকে নাকি পাথর ছুড়ে মেড়েছিলো, সারা পাড়া তখন ওর পাশবিক হাসিতে জেগে উঠেছিলো।


আমি হেসে বললাম, দোষটা আমাদেরই। ভালোবাসার মার্কেট ভ্যালুটা ওকে জানানো হয়নি যে। ওটা তো বিনামূল্যে পাওয়া যায় না।

Sunday, 26 March 2017

বুড়োর নবজন্ম এর আমানত আছে "গুলজার"এ

-কিরে, সেল্ফের মধ্যে থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছিস যে! ভালোই আছিস, আর আমার দেখ কত কাজ। এখ্খুনি বুড়ো আবার আমাকে নিয়ে ক্লিক ক্লিক শুরু করবে।  তবে.... যতই হোক কর্মই ধর্ম।  এখন আমার কাজ করার দিন। হে হে আর তোর পরে পরে ঘুমানোর আর আমার দিকে ঈর্ষার উঁকি-ঝুঁকির দিন। কিরে ভুল বললাম? খিক খিক।

- হমমম

- শুধু হমমম ! অবশ্য কিই বা বলবি। উইগুলো সব লাইন দিয়ে তোর ওই সেলফের দিকেই। যা সামলা ওদের। তোদের নিয়ে এই হচ্ছে মুশকিল।  কোনো কাজেও আসবি না, উপরন্তু আবার হেভি মেইন্টেনেন্স কস্ট।  বুড়ো যে কেনো তোদের লাইব্রেরিতে দিয়ে দিচ্ছেনা, বুঝিনা। বেকার ঝামেলা।


- (মুচকি হাসি) ওটি হবে না হে ছোকড়া। ওই কোনায় ঢুলছে "মধুসূদন রচনাবলী", ওর ১০৮ নম্বর পাতার ভাঁজে রাখা শুকনো গোলাপ নিয়ে দেখিস না বুড়ো কিরকম আদিখ্যেতা করে প্রতি দুপুরে। ওই যে সমরেশ বসুর "প্রজাপতি" চোখ পিটপিট করছে। ওকে পড়তে গিয়ে সেকি কান্ড, বুড়োর চোখের সব কান্না কোপাই হয়ে বয়েছিল পাতায় পাতায়। এখনো তার স্রোতের শব্দ শোনা যায়  মাঝে মাঝে। আর আমি, মানিকবাবুর "পুতুল নাচের ইতিকথা", প্রতি বিকেলে চা খেতে খেতে বুড়ো যখন তাকায় আমার দিকে,  মনে মনে কি জিজ্ঞেস করে জানিস,"শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?" সে মনের হদিস আমার কাছেই যে পায়, "শশী"বুড়ো। আর এই যে "গুলজার" হেলে আছে। বুড়োর নবজন্ম এর আমানত আছে "গুলজার"এ। এ না থাকলে তো কবেই সন্ন্যাসী হয়ে যেত বুড়ো। তখন কোথায় থাকতিস তুই, তোর স্ক্রল আর তোর ক্লিক ক্লিক। যতই চাচা চৌধুরীর নব সংস্করণ হও হও হে হিরো, কোথায় পাবে পাতার পর পাতায় লেগে থাকা সেই হাজার কথা মনে করিয়ে দেওয়া গন্ধ আর ছোট্ট সেই হাতে লেখা পেজমার্কগুলো, যার একটাতে প্রথম "আই লাভ ইউ" লেখা লাল কালিতে। কোথায় পাবে? কোথায় পাবে!

নয় এ মধুর খেলা

"নয় এ মধুর খেলা"
----
মনে আছে একটু একটু করে খড় দিয়ে, কুটো দিয়ে, ঘাস দিয়ে বেঁধেছিলাম ঘর। 
----
"তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল-সন্ধ্যাবেলা নয় এ মধুর খেলা"
----
প্রথম প্রথম যেদিন ঘর বাঁধলাম আর ঝড় এলো, তোমার চোখের কোনে দেখেছিলাম চিকচিক জল। তবু তোমার সাথে ছিলাম আমি, আর ভাগ্যিস আমার সাথে তুমি। তাই তো ওই ঝড় শুধু ঘরটাকেই তছনছ করলো। আমাদের শক্ত করে ধরে থাকা তো নষ্ট করতে পারেনি। আমাদের উষ্ণতাকে তো হিম করতে পারেনি। আমাদের পাখা চারটিকে শিথিল করতে পারেনি। পরের বার ঝড় আমাদের মুচকি হাসি দেখে খানিক ভয়ই পেয়েছিলো জানো? কেমন পালিয়েছিলো অর্ধ্যেকরাস্তায়। তোমার সাথে ছিলাম আমি, আর ভাগ্যিস আমার সাথে তুমি।
-----
"কতবার যে নিবল বাতি, গর্জে এল ঝড়ের রাতি
সংসারের এই দোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা"
-----
বুড়ো পাখিটার নজর ছিল আমার ওপর। সেদিন প্রথম জানলাম তুমি রাগতেও পারো। আমার সর্বাঙ্গে কাটা দিয়েছিলো প্রথম। তোমার চোখে প্রথম সেদিন দেখেছিলাম ত্রাস। আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় ছিল বুঝি? জিজ্ঞেস করিনি কোনোদিন, আজ বলবে? শত ডানা ঝাপটানোতেও মোটেই সে বুড়ো বাঁধ মান ছিলো না, মনে আছে তোমার? শেষে যখন একসাথে এগিয়ে গেছি মরিয়া হয়ে, পিছু হটে গেলো। আজ ভাবলে অবাক লাগে। ও যদি পিছু না হটত? যদি ঘুরে দাঁড়াতো, এগিয়ে আসত? সত্যি কতটুকু ক্ষমতা ছিল আমাদের বলো। সত্যিই কি আটকানো যেত? তবে একটা প্রবল ইচ্ছাশক্তি ছিল আমাদের। ওতেই বোধহয় ...... আর হারানোর মতো কিইবা ছিল আমাদের বলো। তুমিই তো আমার সব। তোমার সাথে ছিলাম আমি, আর ভাগ্যিস আমার সাথে তুমি।
-----
"বারে বারে বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে।
দারুণ দিনে দিকে দিকে কান্না উঠেছে।"
-----
তুমি শুনতে পাচ্ছো? ওগো সত্যি শুনতে পাচ্ছো গো। মনে নেই তোমার সাথে ছিলাম আমি, আর ভাগ্যিস আমার সাথে তুমি। তবে আজ বলছো কেন, ছেড়ে যাবে? এই দুটি শব্দ আমার সব কিছুকে গুলিয়ে দিচ্ছে যে। কোনটা ভুল ছিল? কোনটা ঠিক ছিল? কোনটা স্বপ্ন ছিল? কোনটা বাস্তব? আমার সব গল্পগুলোর শব্দ এদিক ওদিক ছিটকে পড়ছে। ওদের জুড়বো সেই শক্তিটাও তুমি কেড়ে নেবে? এমন অবলীলায় বলছো, ছেড়ে যাবে? কার সাথে চলে যাবে, সে জিজ্ঞাসা করার সাহস আমার নেই। তোমাকে অনুযোগ করবো, তাও পারছি না। তুমি তো কিচ্ছু লুকোলে না, অকপটে বলে দিলে, ছেড়ে যাবে। তোমার চোখে ভয় নেই তো, মিথ্যা নেই তো। কিন্তু চিকচিক করছে কি একটা যেন। এর থেকে তুমি যদি আমার সাথে লুকোচুরি করতে, তোমার ওপর রাগ করতাম, খুব রাগ করতাম, খুব বকতাম তোমায়, খুব খারাপ কথা বলতাম। তাতে হয়তো একদিন সবকিছু ভুলেই যেতাম। কিন্তু তুমি তো তা করলে না. শুধু বললে, ছেড়ে যাবে। কিভাবে মনকে বোঝাবো? কিভাবে বলবো মনকে, "ভালো হয়েছে চলে গেছে, ও একটা শয়তান ....." সে যে তুমি নও, সে আরও একবার প্রমান করলে অকপটে বলে। তাহলে তোমার চোখ চিকচিক কেন? তবে তাই হোক, শুধু ঐটিই নিয়ে তাহলে আমি বাঁচি। তবে যায়, চলে যাও, আর কিছু বোলো না, চলে যাও। আমার জন্য এই তো অনেক, আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সময়, তোমার চোখের কোণে চিকচিক। তোমার প্রেমে আঘাত পেলাম, অবহেলা নয় বটে।
------
"ওগো রুদ্র, দুঃখে সুখে এই কথাটি বাজল বুকে—
তোমার প্রেমে আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা
নয় এ মধুর খেলা"
------

Wednesday, 22 March 2017

জীবন মানেই জিবাংলা 2

রসিকবাবু হনিমুনে। না মানে একটু খাঁদমিশ্রিত হনিমুনে।
যৌথ পরিবারে আর হনিমুন! কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বললেই মিনিমাম সতেরোজন সঙ্গে সঙ্গে তল্পিতল্পা নিয়ে রেডি। তাই আপিসের কাজে উড়িষ্যা যেতে হবে শুনে অফারটা বাগিয়ে নিলেন রসিকবাবু। এব্রিথিং ইস ফেয়ার ইন লাভ। আর ওয়ার নিয়ে শান্তপ্রিয় রসিকবাবুর কোনো কাজ নেই। পাতের পেঁপের মতো জীবনের থালা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন।
রসিকবাবু এসে হাজির উড়িষ্যায়। কথামতো গিন্নিও বাপের-বাড়ি-যাবে অজুহাতে, সাথে সাথে। সব একদম মাখনের মতো হলো।
বাড়ি থেকে কেউ একটিবারও ট্যাফোঁ করতে পারেনি। ইয়াহুহুহুহুহুহু। অফিসের গেস্ট হাউসটিও বেশ। ঢুকেই বাথরুমটা দেখে নেওয়া মাস্ট। ঐটিতেই আত্মার সম্পর্ক। পরিষ্কার বাথরুমের পরিবর্তে একবাটি ইলিশ? উহু তুচ্ছ, তবে যদি স্ট্রেইট ফ্রম পদ্মা হয়, তাহলে ওই ইয়ে আর কি। যাহোক বিছানা পরিষ্কার। ঘরে জল? তোয়ালে? সব জায়গামতো অবস্থিত। পারফেক্ট। অফিসে ঢু মারতে হবেই। তাড়াতাড়ি চলে আসতে হবে এদিক-ওদিক ম্যানেজ করে। গিন্নিকে ফ্লাইং কিস দিয়ে বেরিয়ে যাবেন যেই, গিন্নি বলে উঠলেন,"বলছি, টিভির রিমোটটা?" "ধুস, এই তো নাও। চলে আসবো তাড়াতাড়ি বুঝলে?" রসিকবাবু বলে বেরিয়ে গেলেন। এ
র পরের কয়েক ঘন্টা কাটানো যেন জিও সিমের নেটওয়ার্ক খোঁজা। কিছুতেই ঘড়ির কাটা আর নড়ে না। ফাইলের পর ফাইল, শেষ আর হয়না। লঙ্কাহীন মামলেট গেলা এর থেকে সহজ। বিকেল সাড়ে পাঁচটা অব্দি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ফটোগ্রাফারদের মতো উত পেতে বসে ছিলেন। ঠিক সাড়ে পাঁচটা বাজতেই বেরিয়ে এলেন ঝোপ থেকে। এদিক ওদিক দেখে চুপি চুপি গুটিগুটি পায়ে কোনোরকমে বসের কেবিনটা ক্রস করতেই উনি ভ্লাদিমির লেনিন। তেমনি দর্পে গটগটিয়ে ঘরে ঢুকলেন। গিন্নি কোথায়? বাথরুমে? উহু? তবে? বিছানার ওপরে লেপ মোড়া? বোঝো ..... গিন্নি এসি চালিয়ে, লেপ মুড়িয়ে, জড়িয়ে, ঘুমিয়ে, রসিয়ে, খানিক কষিয়ে, নাক ডাকিয়ে, সুরে সুরে ভনভনিয়ে ওই আর কি  ..... ঘুমোচ্ছেন।
ধ্ধ্যুস বলে বিমর্ষ রসিকবাবু বসতে যাবেন খাটে, অমনি কর্কশ আওয়াজে,"আজ ব্লু হ্যা পানি পানি  ....." বেজে উঠলো। গিন্নির মোবাইলের অ্যালার্ম আর অমনি গিন্নি ধড়মড়িয়ে উঠলেন। রসিকবাবুর চেহারায় হাসি ফুটে উঠলো। যাক।
গিন্নি -"ওমা তুমি এসে গেছো? কখন এলে?"
রসিকবাবু হামাগুড়ি দিয়ে চোখ সরু করে গিন্নির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে-"চাহে কোই মুঝে জংলী কহে  ..... "
গিন্নিও মুচকি হেসে-"কেহেনে দো জি কাহ্তা রাহে  ...."
রসিকবাবু উল্লাসে -"হাম পিয়ার কে তুফানো মে  ....."
অমনি আবার "আজ ব্লু হ্যা পানি পানি  ....." বেজে উঠলো।
রসিকবাবু-" ওহ কি মুশকিল, এটা বন্ধ করতো, থেকে থেকে বাজছে কেনো?"
গিন্নি-"ওহ,এই রে ছটা বাজলো, সরো দেখি সরো। "
রসিকবাবু -,"য়্যা, কি হলো?"
গিন্নি (এক ঠেলা দিয়ে)-"দিদি নম্বর ওয়ান, যাতে মিস না হয় স্নুজ করে রেখেছিলাম মোবাইলের অ্যালার্ম।সরো দেখি সরো। আমি খুব ভাবছিলাম জানো যদি জি বাংলা না আসে এখানে! প্রণাম করে নামজপ করতে করতে ভয়ে ভয়ে টিভি খুলতেই উফফফফ কি শান্তি। বাড়ি ফিরে গোপালকে এক্সট্রা নকুলদানা আর মমমম সরভাজাও দুটো দেব।দেখি সরো"
রসিকবাবু গিন্নির ধাক্কায় ততক্ষনে খাট থেকে নিচে মাটিতে।
রসিকবাবু বিড়বিড় করছেন,"হাম পিয়ার কে তুফানো মে গিরে হ্যা হ্যাম ক্যা করে"





Tuesday, 21 March 2017

জীবন মানেই জিবাংলা

অফিস থেকে ঠিক বেরোনোর মুহূর্তে বুড়ো বস একগাদা ফাইল চাপিয়ে দিয়ে পাঠালেন পিওনের হাত দিয়ে। যারা বলে গভর্নমেন্ট চাকরি সুখের, তাদের বিরিয়ানিতে গাদা গাদা উচ্ছে সিদ্ধ। তাদের রসোগোল্লায় গাদাখানেক নুন। তাদের মটনরোলে সোয়াবিন আর পনির ঠাসা।
"ধ্যাৎ তেরিকা" বলে সব ফাইল ঠেলে বিনীতা ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
মিটির এক্সাম কেমন হলো কেজানে। এতক্ষনে নিশ্চয় এক্সাম শেষ। একটা কল করে দেখ যাক। টিংটিং ফোন , রিং হচ্ছে। কিন্তু ওপার থেকে কোনো উত্তর নেই। "উফফফ" বলে আবার ফোন। এবারও কোনো উত্তর নেই। নিশ্বাসটা জোরে জোরে পড়ছে বিনীতার।
সতেরো বছরের মেয়ে, তবু একা ছেড়ে একমুহূর্তে থাকতে পারে না বিনীতা। সমসময় চিন্তায় থাকে। স্বামীর সাথে ডিভোর্স পাঁচ বছর হলো। মা আর মেয়েকে নিয়ে সমস্ত পৃথিবী বিনীতার।
মা কে ফোন করে দেখি তো। এখানেও রিং হচ্ছে, কিন্তু কেউ ফোন তোলে না। কি  মুশকিল। টেনশনে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড়। তাড়াতাড়ি ট্যাক্সি ধরে জোরে চালাতে বললো বিনীতা। পুরো রাস্তাটা একবার এই ফোন, আরেকবার ওই ফোন। এরকম তো কোনোদিন হয়না। মাঝরাস্তা যখন পৌঁছেছে, বাইরে অফিস টাইমের ট্রাফিক। জঘন্য। নাঃ মিটির বন্ধু কে ফোন করি। টিংটিং ফোন , রিং হচ্ছে।
-হ্যালো
-হ্যা হ্যালো, আমি মিটির মা বলছি
-হ্যা বলুন বিনীতা। আজকের পেপারটা কি বাজে হয়েছে না। সব আউট অফ সিলেবাস। মিটির কেমন হো  .....
- হ্যা মানে বলছি, মিটিকে ফোনে পাচ্ছি না। ওকে দেখেছেন ছুটির পর?
- য়্যা? মিটি? মমমম হ্যা বেরোলো তো। স্কুলভ্যানেও উঠলো দেখলাম, কিন্তু পেপারটা অতি জঘন  .....

যাক্ তাহলে ভ্যানে উঠেছে। বাড়ি পৌঁছেছে।  ......
কিন্তু তাহলে ফোন ধরছেনা কেন। বাড়িতে পৌঁছলে মা বা মিটি কেউই রিং শুনতে পাচ্ছে না? আর পিলামাসি, সেও তো আছে। সেও কি এখনো রান্না ঘরে? ভ্যানওয়ালা ঠিকঠাক পৌঁছে দিয়েছে তো? নাকি? আবার টেনশনে অস্থির হয়ে উঠলো বিনীতা। আর ভাবতে পারছে না, মাথাটা টলমল করছে। হাতগুলো ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছলো। তাড়াতাড়ি ভাড়া মিটিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকলো। বাড়ির একটা চাবি বিনীতার কাছে থাকে। সব্বাই উপরের ঘরে থাকে। হাঁকুপাঁকু করে উপরে উঠতেই এদিক ওদিক দেখে, কেউ কোথাও নেই। মা র ঘরের দরজা বন্ধ। পড়িমরি ঠেলে ঢুকতেই দেখে প্রচন্ড শব্দে টিভি চলছে।  আর মা, মিটি , পিলামাসি সব বুঁদ হয়ে টিভির দিকে। "টেন পোয়েএএএএএএএএএন্টস, দি  .. দি  .. নম্বর ওয়ান। দি  .. দি  .. নম্বর ওয়ান।"
প্রচন্ড রাগে বিনীতা বলতে শুরু করলো,
"কি ব্যাপার কি হ্যা? তখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি? তোমরা কি পাগল? কোনো কান্ডজ্ঞান নেই নাকি হ্যা? অফিসের সমস্ত টেনশন নিয়ে আছি, তার ওপর ফোনটা ধরারও প্রয়োজন  বোধ  ....."

মা: "কুমড়ো   ....."
মিটি: "না গো দিম্মা, আনসারটা ক্যাডবেরি হবে ...."
পিলামাসি: "না না, কোনো সব্জির নাম বলতি হবে  ....."

সব দেখে ধপ করে বসে পড়লো বিনীতা। বসতে গিয়ে দেখে চেয়ারে ডাই করে রাখা সব জামাকাপড়, তার মধ্যে মা আর মিটির ফোনদুটো চোখ পিটপিট করে অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে।

Monday, 6 March 2017

রিকি বললো,"আমার মা শুধু পাপার হাত ধরে থাকে।"

রিকির আজ ক্লাস ফোর হলো। নতুন ক্লাসে শুরুর দিনে সবাইকে নিজের ব্যাপারে চার লাইন বলতে বলা হলো। ছোট্ট ছেলেমেয়েরা নানারকম ভাবে নিজেদের কথা বলছে। এবার পালা রিকির। রিকি বেঞ্চ থেকে উঠে ধীরে ধীরে গেলো সামনে। শুরু করলো।
"আই এম রিকি বোস। মাই ফাদার ইস ধীমান বোস। মাই মাদার ইস শর্মিলা বোস। মাই ফাদার ইস এ পোয়েম   ....."
কেউ কেউ হাসতে শুরু করলো। টিচার বললেন,"রিকি, নট পোয়েম বেবি, ইট উইল বি পোয়েট"
রিকি বললো,"উফফ, সরি টিচার, মাই ফাদার ইস এ পোয়েট। মাই মাদার ইস এ  ......" বলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে রিকি।
টিচার পরিস্থিতি সামাল দিতে বললেন,"ওকে, ভেরি গুড, নেমে এসো রিকি। হু ইস নেক্সট?" সমস্ত ক্লাস যথারীতি ক্লাপ করলো। উঠে পড়লো পরের জন।
রিকি বেঞ্চে ফিরে আসতে পাশে বসা বন্ধু টনি জিজ্ঞেস করলো,"তুই কেনো স্টেমার করছিলি? চুপ করে গেছিলি কেনো হঠাৎ? তোর মা কি করে? ডক্টর? হাউজওয়াইফ?"
রিকি বললো,"আমার মা শুধু পাপার হাত ধরে থাকে।"
টনি হেসে উঠলো,"শুধু পাপার হাত ধরে থাকে? আর কিছু করে না? আর ইউ ম্যাড রিকি?"
রিকি মাথা নিচু করে বিড়বিড় করলো,"সত্যি বলছি"
বাড়ি ফিরে টনি সব কথা মাকে বলছে, আর হাসছে। যত হাসছে, মার মুখ তত গম্ভীর হচ্ছে। শেষে মা বললো,"টনি বেবি, তুমি রিকির থেকে একটু দূরে থাকবে হ্যা? যা বলছি শুনবে কিন্তু। হি ইস ইল"
ইল!!
পরের দিন টনির মা দেখা করলেন রিকির বাবার সাথে, সব বললেন, শেষে বললেন,"আমার মনে হয় ওকে ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো দরকার। মানে বাইরে থেকে তো ও সুস্থ। প্লিজ ডোন্ট টেক মি রং। হয়তো মায়ের অভাবটা ফিল করতে করতেই  ......"
রিকির বাবা টলোমলো পায়ে বাড়িতে ঢুকেই খোঁজ করলেন ছেলের। ছেলে ঘুমোচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গা অব্দি অপেক্ষা করতে সোফায় ঠাঁয় বসে ভাবলেন। এ কি ভাবে সম্ভব। সত্যি ছেলে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে?
তখন ছটা হবে, ছেলে পিছন থেকে "পাপা, এসে গেছো" বলে গলা জড়িয়ে ধরলো। বাবা শান্ত ভাবে, রোজের মতো স্কুলের সমস্ত গল্প শুনলেন। কিন্তু ক্লাসের ঘটনাটা এড়িয়ে গেলো রিকি। বাবা জিজ্ঞেস করলেন," রিকি সোনা, তুমি জানো তোমার মা আকাশের ষ্টার, বলেছি না কতবার? তবে তুমি টনিকে আজ ওরকম বললে কেনো?"

রিকি চমকে গেলো, পাপা জানলো কি করে? বিড়বিড় করে চোখ ছলছল রিকি বললো,"মা সবসময় তোমার হাত ধরে থাকে। দাদুকে বলেছিলাম, দাদুও বিলিভ করেনি। আমাকে বকলো, তোমাকে বলতে বারণ করেছিল...তাই তো আমি … এখনো মা তোমার হাত ধরে আছে, তুমি একবার ঘুরে আয়নায় দেখো? পাপা, মা তোমার সাথেও কথা বলে না? কি হলো পাপা, কথা বলো, তুমি কি ভয় পেয়েছো?"

Thursday, 2 March 2017

অমুকবাবু কি বাঙালি?

মিস্টার অমুক। দুর্ভাগ্যক্রমে ওনার জন্ম ভারতবর্ষের বাংলায়। ইংলিশ মিডিয়ামে বড় হতে হতে তিনি দুর্ভাগ্য আরও বেশি অনুভব করেছেন। তার জীবনে এ লেগে আছে কলঙ্কের মত। সে নিয়ে তার লজ্জার শেষ নেই। চাকরিজীবনের আগে এ কলঙ্ক থেকে বাঁচার চেষ্টার ত্রূটি ছিলনা বিন্দুমাত্র। ভাঙা-ব্যাঁকা-ন্যুব্জ-ক্ষীণ ইংলিশ নিদেনপক্ষে হিন্দি ব্যবহার করেছেন প্রতি মুহূর্তে, বাংলায় তার সাবলীলতাকে সচেতনভাবে, খানিক নির্দয়ভাবে অস্বীকার করে। "হাত দিয়ে খেতে তার অসুবিধার" কথা প্রকাশ করেছেন বারে বারে প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক পরিস্থিতিতে। বাবা-মার সাথে তাজমহল ঘুরতে গিয়ে প্রথম ধপধপে সাদা চামড়াওয়ালা মানুষ পড়ে তার চোখের সামনে। তার সাথে ছবি তোলার বায়না তার বাবাকে অস্বস্থিতে ফেললেও মা সে সাধ পুরণে আকাশ-বাতাস এক করে দিয়েছিলেন। ছেলেটির অনুরোধে সে ছবি দেখতে হয়েছে, খানিক বাধ্য হয়েই পরিচিত স্বজন-কুজনদের। ছোট্টবেলায় যতটুকু সম্ভব আর কি। চাকরিজীবনে পৌঁছনোর পর প্রথম শর্তই ছিল, চাকরি হতে হবে বাংলার বাইরে। মিলেও গেলো একটি, আইটির ঘাঁটি বেঙ্গালুরুতে। সেখানে গিয়ে যথাসম্ভব চেষ্টা করতেন, নিজের আদি বাড়ির কথা সর্বসম্মুখে না আনতে। কেউ কখনো তাকে যদি জিজ্ঞেস করতেন,"আর ইউ পাঞ্জাবি" বা "আর ইউ ফ্রম সাউথ", একরাশ খুশি ফুটে উঠতো তার চোখে মুখে। বাংলায় আর প্রায় আসেনি না অমুকবাবু। সমগ্র বাংলা তখন তার কাছে গলে যাওয়া ভাতের মতো। এহেন অমুকবাবু রোজের মতো একদিন বেড়িয়েছেন প্রাতঃভ্রমণে। আগের দিন বার্থডে সেলেব্রেশন জোড়দার হয়েছে। তাই প্রাতঃভ্রমণটা আজ মাস্ট। একপাঁক ঘুরতেই পেট মোচড়, কিছুতেই আর চলতে পারছেন না। বসে পড়লেন কাছাকাছি একটি বেঞ্চে। মাথা ঘুরছে, চোখ অন্ধকার। 
****
চোখ খুলতেই দেখলেন নিজের ঘরে শুয়ে আছেন, আর সামনে একটি মাঝারি সাইজের টাক মাথা লোক দাঁড়িয়ে। লোকটি মুচকি হেসে বলতে শুরু করলেন,"যাক, জ্ঞান ফিরেছে তাহলে, আর একটু দেরি হলেই ডাক্তার ডাকতে হতো।"
অমুকবাবু বলে উঠলেন,"বাঙালি? এই রে … আই মিন আর ইউ বেঙ্গলি? আই ডোন্ট সিম টু নো ইউ, এন্ড হোয়াই দা হেল ডিড ইউ এন্টার হিয়ার উইথাউট মাই পারমি ...... "
লোকটি বলে উঠলেন,"দাঁড়ান দাঁড়ান, উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? পার্কে দেখি বেঞ্চিতে শুয়ে গোঙাচ্ছেন। আমি বুঝলাম, এসিডিটি। যতই হোক বাঙালি তো, গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারি, জেলুসিল কেস না নেক্সট লেভেল।"
অমুকবাবুর মুখে রা টি নেই। 
লোকটি বলে চলেছেন,"একটু চেনা লাগছিলো আপনাকে। গোঙাতে গোঙাতে যেই বললেন, গলা জ্বালা। ব্যাস, একদম স্ট্রেইট ব্রেনে কিক। কোরামঙ্গলাতে তো, দুর্গাপুজোর চাঁদা চাইতে এসেছিলুম না দু-বছর আগে? কে যেন খবর দিলো এই ফ্ল্যাটে বাঙালি আছে। আপনি কি সব ভাষা বলতে শুরু করলেন, সেই থেকে আপনাকে আর ঘাটায়নি, মানে ইয়ে সরি। যাকগে, তারপর ট্যাক্সি ফ্যাক্সি ডেকে এখানে পৌঁছে, বিল্ডিংয়ে উঠলুম। তারপর তো কি জ্বালা। আপনার সাউথইন্ডিয়ান বাড়িওয়ালা চাবি দিতেই চায়না। বলি মশাই দেখতে পাচ্ছেন না, একজনের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। তারপর ওই পাতি বাঙালি কায়দায় মালটাকে হাত করলাম। বললাম, আমরা একই শহরের কলকাতার, আইডি কার্ডটা দিয়ে আস্তে হলো শেষে। ভদ্রলোকের যত চিন্তা বাড়ির সেফ্টিতে, মানুষের জীবনটিতে ততটা নয়। আর বলুন কিছু জানার আছে?" 
অমুকবাবু ধাতস্থ হচ্ছেন ধীরে ধীরে। রোবটের মতো হঠাৎ বলতে থাকেন,"আমি কি বলে যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবো, আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছেন" 
লোকটি বলেন,"ও কিছু নয়, আমরা সব ভিনদেশে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। নিজেদের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে হবে অনলি টু সার্ভাইভ। আচ্ছা জ্ঞান দিয়েছি আপনার বাড়িওয়ালাকে। ব্যাটা আমাকে সন্দেহ করছিলো? আচ্ছা ভদ্রলোক কিরকম ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে ছিলেন, যখন জানলেন আপনি বাঙালি.যাক, আপনি রেস্ট নিন। আসুন না মাঝে মাঝে আমাদের আসোসিয়েশনে। জমিয়ে আড্ডা হবে। আসি।”
অমুকবাবুর পেটব্যাথা একদম নেই এখন আর, কিন্তু মাথাটা যেন আবার ঘুরছে, ধন্যবাদ-জ্ঞাপন-জীবন-রক্ষা এই এতগুলো বাংলা শব্দ কি করে তিনি নিজে মুখে বললেন!