Thursday, 2 March 2017

অমুকবাবু কি বাঙালি?

মিস্টার অমুক। দুর্ভাগ্যক্রমে ওনার জন্ম ভারতবর্ষের বাংলায়। ইংলিশ মিডিয়ামে বড় হতে হতে তিনি দুর্ভাগ্য আরও বেশি অনুভব করেছেন। তার জীবনে এ লেগে আছে কলঙ্কের মত। সে নিয়ে তার লজ্জার শেষ নেই। চাকরিজীবনের আগে এ কলঙ্ক থেকে বাঁচার চেষ্টার ত্রূটি ছিলনা বিন্দুমাত্র। ভাঙা-ব্যাঁকা-ন্যুব্জ-ক্ষীণ ইংলিশ নিদেনপক্ষে হিন্দি ব্যবহার করেছেন প্রতি মুহূর্তে, বাংলায় তার সাবলীলতাকে সচেতনভাবে, খানিক নির্দয়ভাবে অস্বীকার করে। "হাত দিয়ে খেতে তার অসুবিধার" কথা প্রকাশ করেছেন বারে বারে প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক পরিস্থিতিতে। বাবা-মার সাথে তাজমহল ঘুরতে গিয়ে প্রথম ধপধপে সাদা চামড়াওয়ালা মানুষ পড়ে তার চোখের সামনে। তার সাথে ছবি তোলার বায়না তার বাবাকে অস্বস্থিতে ফেললেও মা সে সাধ পুরণে আকাশ-বাতাস এক করে দিয়েছিলেন। ছেলেটির অনুরোধে সে ছবি দেখতে হয়েছে, খানিক বাধ্য হয়েই পরিচিত স্বজন-কুজনদের। ছোট্টবেলায় যতটুকু সম্ভব আর কি। চাকরিজীবনে পৌঁছনোর পর প্রথম শর্তই ছিল, চাকরি হতে হবে বাংলার বাইরে। মিলেও গেলো একটি, আইটির ঘাঁটি বেঙ্গালুরুতে। সেখানে গিয়ে যথাসম্ভব চেষ্টা করতেন, নিজের আদি বাড়ির কথা সর্বসম্মুখে না আনতে। কেউ কখনো তাকে যদি জিজ্ঞেস করতেন,"আর ইউ পাঞ্জাবি" বা "আর ইউ ফ্রম সাউথ", একরাশ খুশি ফুটে উঠতো তার চোখে মুখে। বাংলায় আর প্রায় আসেনি না অমুকবাবু। সমগ্র বাংলা তখন তার কাছে গলে যাওয়া ভাতের মতো। এহেন অমুকবাবু রোজের মতো একদিন বেড়িয়েছেন প্রাতঃভ্রমণে। আগের দিন বার্থডে সেলেব্রেশন জোড়দার হয়েছে। তাই প্রাতঃভ্রমণটা আজ মাস্ট। একপাঁক ঘুরতেই পেট মোচড়, কিছুতেই আর চলতে পারছেন না। বসে পড়লেন কাছাকাছি একটি বেঞ্চে। মাথা ঘুরছে, চোখ অন্ধকার। 
****
চোখ খুলতেই দেখলেন নিজের ঘরে শুয়ে আছেন, আর সামনে একটি মাঝারি সাইজের টাক মাথা লোক দাঁড়িয়ে। লোকটি মুচকি হেসে বলতে শুরু করলেন,"যাক, জ্ঞান ফিরেছে তাহলে, আর একটু দেরি হলেই ডাক্তার ডাকতে হতো।"
অমুকবাবু বলে উঠলেন,"বাঙালি? এই রে … আই মিন আর ইউ বেঙ্গলি? আই ডোন্ট সিম টু নো ইউ, এন্ড হোয়াই দা হেল ডিড ইউ এন্টার হিয়ার উইথাউট মাই পারমি ...... "
লোকটি বলে উঠলেন,"দাঁড়ান দাঁড়ান, উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? পার্কে দেখি বেঞ্চিতে শুয়ে গোঙাচ্ছেন। আমি বুঝলাম, এসিডিটি। যতই হোক বাঙালি তো, গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারি, জেলুসিল কেস না নেক্সট লেভেল।"
অমুকবাবুর মুখে রা টি নেই। 
লোকটি বলে চলেছেন,"একটু চেনা লাগছিলো আপনাকে। গোঙাতে গোঙাতে যেই বললেন, গলা জ্বালা। ব্যাস, একদম স্ট্রেইট ব্রেনে কিক। কোরামঙ্গলাতে তো, দুর্গাপুজোর চাঁদা চাইতে এসেছিলুম না দু-বছর আগে? কে যেন খবর দিলো এই ফ্ল্যাটে বাঙালি আছে। আপনি কি সব ভাষা বলতে শুরু করলেন, সেই থেকে আপনাকে আর ঘাটায়নি, মানে ইয়ে সরি। যাকগে, তারপর ট্যাক্সি ফ্যাক্সি ডেকে এখানে পৌঁছে, বিল্ডিংয়ে উঠলুম। তারপর তো কি জ্বালা। আপনার সাউথইন্ডিয়ান বাড়িওয়ালা চাবি দিতেই চায়না। বলি মশাই দেখতে পাচ্ছেন না, একজনের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। তারপর ওই পাতি বাঙালি কায়দায় মালটাকে হাত করলাম। বললাম, আমরা একই শহরের কলকাতার, আইডি কার্ডটা দিয়ে আস্তে হলো শেষে। ভদ্রলোকের যত চিন্তা বাড়ির সেফ্টিতে, মানুষের জীবনটিতে ততটা নয়। আর বলুন কিছু জানার আছে?" 
অমুকবাবু ধাতস্থ হচ্ছেন ধীরে ধীরে। রোবটের মতো হঠাৎ বলতে থাকেন,"আমি কি বলে যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবো, আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছেন" 
লোকটি বলেন,"ও কিছু নয়, আমরা সব ভিনদেশে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। নিজেদের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে হবে অনলি টু সার্ভাইভ। আচ্ছা জ্ঞান দিয়েছি আপনার বাড়িওয়ালাকে। ব্যাটা আমাকে সন্দেহ করছিলো? আচ্ছা ভদ্রলোক কিরকম ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে ছিলেন, যখন জানলেন আপনি বাঙালি.যাক, আপনি রেস্ট নিন। আসুন না মাঝে মাঝে আমাদের আসোসিয়েশনে। জমিয়ে আড্ডা হবে। আসি।”
অমুকবাবুর পেটব্যাথা একদম নেই এখন আর, কিন্তু মাথাটা যেন আবার ঘুরছে, ধন্যবাদ-জ্ঞাপন-জীবন-রক্ষা এই এতগুলো বাংলা শব্দ কি করে তিনি নিজে মুখে বললেন!

No comments:

Post a Comment